গত বছর গ্রীষ্মের সময়ে নোনসিয়া ছিল আমাদের এই মহল্লায়। ও ছিল এ এলাকার প্রাণবায়ুর মতো। তখন নোনসিয়া ছিল এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী নারী…। সে ছিল প্রাণরসে ভরপুর, সর্বদা হাসিমুখ, টগবগে এক যুবতী।
তবু ওই মেয়ের তার স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হতো না। তাই ঘরে শান্তিও ছিল না তার। স্বামী তাকে কখনো বুঝে নিতে পারেনি। সে ঘরে চেঁচামেচি করত। মুখ খারাপ করত। ছুরি বের করে ভয় দেখাত। এমনি এক দিন সে একটা লোককে ছুরি মেরে দিয়েছিল। ফলে এমন গুণ্ডা-বদমাশ লোকের যা পরিণতি হয়, তাই হয়েছে। তার জেল হয়ে গেল।
আবার জেল থেকে বেরিয়ে নোনসিয়ার স্বামী স্টেফানো চলে গেল আর্জেন্টিনায়। আর কোনো দিন ফিরে এলো না লোকটা। তখনই নোনসিয়ার বয়স তেইশ বছর মাত্র। প্রায় বিধবা সে।
তার সঙ্গী-সাথি এখন তারই একমাত্র মেয়েটি। যার বয়সে এখন মাত্র পাঁচ বছর। আর একজোড়া খচ্চর ও একটি সবজির খেত। আরো আছে একটি গাড়ি। এই হলো তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। তবে এমন সদাপ্রসন্ন মানুষদের এর চেয়ে বেশি কিছু দরকার হয় না। তারা এটুকুতেই খুশি থাকে। তা ছাড়া নোনসিয়া নানা রকম কাজকর্মও জানে। লোকের সঙ্গে সদ্ভাব রাখার জন্য, সুন্দর চেহারার জন্য সে চাইলেই যেকোনো মানুষের সাহায্য পেয়ে যায়।
পরিবর্তে সে সাহায্যকারীর উপকারের প্রতিদান দিত, শোধ করত তার মিষ্টি হাসি, আচরণ দিয়ে। আর যখন উপকারের প্রতিদান টাকাপয়সা আর ব্যবহার দিয়ে শোধ হতো না, তখন সে ওর সবের চেয়েও মূল্যবান, যা নাকি অর্থের বিনিময়ে পরিশোধ করবার সামর্থ্য তার হতো না, চাইত না—তখন সে ওদের মজুরি সেভাবেই শোধ করে দিত।
কিন্তু এসব তো তার মহল্লার নারীদের নজরেও পড়ত। তারা বুঝতে পারত তাদের মেয়েলি দৃষ্টি দিয়ে। তাই তারা নোনসিয়াকে পছন্দ করত না। পুরুষদেরও অনেকে তার ওই সহজ-সরল হাসিখুশি গায়ে পড়া স্বভাব পছন্দ করত না। ও নিজেও অবশ্য বিবাহিত পুরুষদের থেকে দূরেই থাকত।
আবার কখনো বা সে তার প্রতিবেশী বাড়ির স্বামী-স্ত্রীদের পারিবারিক কাজেও সাহায্য করত। নোনসিয়া বলত, যে পুরুষ কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে ছেড়ে দেয় কিছুদিন পর, সে আসলে মেয়েটিকে কখনো ভালোবাসেনি।
এক জেলে ছিল ওদের মহল্লায়! তার নাম আবতোরোলানো। লোকটা তার অল্প বয়সে এক ধর্মীয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিল। পরে সে পাদরি হওয়ার শিক্ষানবিস করেছিল। পাদরি হয়ে থাকেনি বেশি দিন। ছেড়ে দিয়েছিল ওই পদ। সে মাছ ধরা আর মদ-মাংসের মোহে পড়ে গেল। একসময় ওই লোক অসভ্য আর নির্লজ্জ ভাষায় গান বাঁধত। ওকে একদা নোনসিয়া বলেছিল, তুমি জানো না, সব ধর্মের চেয়ে প্রেমধর্ম বেশি জটিল। আমার লেখাপড়া বেশি নেই। কিন্তু তোমার ওই বাজে গানগুলোর মানে বুঝি।
দিন যায় এভাবে নোনসিয়ার। অনেক লোকের ওকে ভালো লাগে। ফলে সুখেই দিন কাটছে তার। একদা যারা ওকে হিংসা ঈর্ষা-ঘৃণা-বদনাম করত, তারা সময়ের পরিবর্তনে সেসব ভুলে যেতে লাগল। অনেক ক্ষেত্রে তারা নোনসিয়াকে ক্ষমা করে দিল। লোকে এখন ধরে নিল, বউটি ওই রকমই। ওর স্বভাব-চলন-বলন ওই রকম থাকবে। আর বদলাবে না, বদলায় না।
তা প্রায় দশটি বছর ছিল নোনসিয়া এখানে এই এলাকায়। যত দিন ছিল তার ভালোমন্দ নিয়ে সে রীতিমতো নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে ছিল। যার মনে যাই থাক, মেয়েটি প্রকৃতই সুন্দরী, গুণী আর ভালো নতর্কীও—এটা সবাই স্বীকার করেছে। ও যদি তেমন জায়গায় আর তেমনভাবে পরিশীলিত হতে পারত। তাহলে আরো প্রশংসা পেতে পারত। কারণ তার সঙ্গে তুলনীয় আর কোনো সুন্দরী যুবতী তখন ওই এলাকায় ছিল না।
এই মেয়ে, তুই কি জানিস—খেলা, কামনা আর প্রেমের ক্ষেত্রে খুব মজবুত বুক চাই। আর সে বুক, সে রকম নারীদেরই থাকে—যারা জীবনের প্রতিটি পরীক্ষা পার হয়ে এসেছে
কিছু পরদেশি লোকেরও নজর পড়েছিল তার ওপর। সে ওদের সঙ্গে একান্তভাবে নিশ্চিত প্রেম-ভালোবাসার খেলা খেলেছিল। নোনসিয়া নিজেই প্রেম-ভালোবাসার কথায় হেসে-নেচে গড়িয়ে পড়ত। এ ব্যাপারে বিদেশিদের বোকামি আর মূর্খামি নিয়ে বেশ হাসাহাসি করত নিঃসংকোচে।
আবার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিও নোনসিয়াকে অর্থের বিনিময়ে আহ্বান করত। তাদের বলত, অপরিচিত ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করার মতো পেঁয়াজ-রসুন আর টমেটো ছাড়া আর তো কিছু নেই। দু-চারজন শুভাকাঙ্ক্ষী ওকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে, খুব বেশি দিন তো নয়। তোমার দিন কি এমনটা চিরকাল থাকবে নাকি? ভেবে দেখো, তোমার একটা মেয়েও আছে। সেও দিন দিন বড় হচ্ছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। দৃঢ়কণ্ঠে বলত নোনসিয়া। আমি আমার এই শরীরটাকে এত ভালোবাসি যে, এর কোনো রকম অযত্ন হতে দিই না। দিতে পারি না। আমি জানি, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি কোনো কাজ করে ফেলা হয়, তাহলে আর কখনো মাথা তুলে চলা যায় না।
কিন্তু তুমি তো কাউকে না বলতে পারো না।
তোমার নিজ পছন্দমতো লোকের বলতে, কী বলতে চাও তুমি?
আমি যাদের মধ্যে বড় হয়েছি, থেকেছি এতকাল, যারা আমাকে সঠিকভাবে চেনে, জানে।
এত কথার মধ্যেও ওই সময়ে একজন লোকের সঙ্গে তার প্রেম সম্পর্ক বজায় ছিল। সে লোকটা আবার ইংরেজ। সে ছিল বন বিভাগের অফিসার। একটু অন্য ধরনের লোক। সে বেশ হাসিখুশি স্বভাবের মানুষ ছিল। এ অঞ্চলের ভাষাও সে বলতে পারত। বয়সে যুবক ছিল। অথচ তার চুলগুলো সবই সাদা ছিল। তার মুখে একটা আঘাতের চিহ্ন দেখা যেত। তবে তাকে দেখাত শিকারির মতোই। কিন্তু তার চোখ দুটো শান্ত ছিল। শান্তিময় দেখাত। কেউ বলত, লোকটা বই লেখে ‘বনজঙ্গল’ নিয়ে। কেউ বলত, লোকটা বদ-জুয়াড়ি।
তারপর একদা জানা গেল, নোনসিয়া ওই লোকটার সঙ্গে চলে গেছে সিসিলি দ্বীপে। আবার ফিরেও এলো কিছুদিন পর। যখন তার চেহারা একেবারে বিধ্বস্ত। ক্লান্ত চোখ-মুখ। লোকটা তার থেকে নিয়েছে খুব। দেয়নি কিছুই। আসলে সে কোনো বড় চাকুরে ছিল না। নোনসিয়াকে সামান্য কিছু টাকাপয়সাও দেয়নি। তাই ফিরে আসতে বাধ্য হলো নোনসিয়া। আগের মতোই শাকসবজি বিক্রি করতে শুরু করল। তবু তার মনটা সদাই প্রফুল্ল থাকত।
নোনসিয়ার মেয়েটি দিন দিন মায়ের মতো হয়ে উঠল। লোকের মুখে এখন মায়ের বদলে মেয়ের প্রশংসা। অবিকল মায়ের চেহারা পেয়েছে সে। ওই রকমই উজ্জ্বল, সদ্য ফোটা ফুলের মতো তাজা। নজর পড়লে নজর ফেরানো যায় না তৎক্ষণাৎ। বয়স মাত্র চৌদ্দ হলো। তার সুপুষ্ট শরীর, দেহের উচ্চতা, মাথায় ঝাঁকড়া কেশরাজি আর গম্ভীর চোখ দুটির কারণে তাকে অনেক বড় দেখায়। ভরা যৌবনে প্রবেশের জন্য সে সবদিক থেকে তৈরি হয়ে গেছে। তাই নোনসিয়া মেয়েকে চেয়ে চেয়ে দেখে। মেয়ের নাম নীনা। বলে, কিরে তুই তো দেখছি আমাকে ছাড়িয়ে যাবি।
নীনা বলে, না গো মা। তুমি যতটা সুন্দরী, আমি ততটা হলেই খুশি।
এই প্রথম নোনসিয়ার চোখ-মুখে চিন্তার একটি কালোছায়া দেখা গেল। সেদিনই সন্ধ্যাবেলা নোনসিয়া তার এক প্রতিবেশী সহেলিকে বলল, দেখো, এই হলো জীবন। একজনের গেলাসের পানীয় শেষ না হতে অন্যজন সেই গেলাসটি নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায়।
আসল কথা কিন্তু বালিকা থেকে কিশোরী হওয়ার সময়টায় মা ও মেয়ের এমন রেষারেষি ভাব ছিল না। মেয়েটি তার স্বাভাবিক মেয়েলি আচরণ লাজলজ্জা নিয়ে মায়ের পেছন পেছন থেকেছে। সে তখন তার বড় বড় চোখের লম্বা লম্বা পাতার ফাঁক দিয়ে দুনিয়া দেখেছে। বয়স্ক মানুষদের সামনে সংকোচে থাকত। কথা কম বলত। আর সে সময়টায় নোনসিয়া হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। মদির আঁখির অধিকারিণী। দুচোখে তার কামনা, লালসা আর মমতার মাখামাখি। এক সর্বজন কাম্য মোহিনী নারী। কোনো বয়স্ক লোক, তরুণ ও যুবক ওর সম্মুখে গেলে উত্তেজনায় লাল হয়ে যেত। যেমন করে সূর্যাস্তের আলো পড়লে মেঘেরা লাল হয়ে যায়। তাই অনেক লোক নোনসিয়াকে চাইত। কামনা করত। পুরুষের ভালো লাগার সমস্ত উপকরণে ওর শরীর পরিপূর্ণ ছিল।
যখন নোনসিয়া তার ছোট্ট গাড়িটি নিয়ে রাস্তায় বেরোত, তখন দূরদূরান্ত থেকে লোক বড় ব্যাকুল দৃষ্টিতে, উৎসুক চোখে ওকে দেখত। বাজারে গিয়ে নোনসিয়া যখন তার শাকসবজি নিয়ে বসত কিংবা দাঁড়িয়ে থাকত, তখন তাকে দেখাত কোনো দক্ষ শিল্পীর আঁকা অপূর্ব এক চিত্রপট। সে তখন বড় সুন্দর নজরে তাকানো এক রূপসী নারী হয়ে থাকত। সে দাঁড়াত ‘সানম্যা কোমা’ গির্জার সিঁড়ির বাঁ-পাশে এক জায়গায়। তখন আবার সে প্রফুল্ল মনে গান গাইত। হাসি-ঠাট্টা করত।
বাজারের ভিড়ে কত-শত নারী-পুরুষের মধ্যে তার উপস্থিতি, অস্তিত্ব, আলোর স্ফুলিঙ্গের মতো ঝরে ঝরে পড়ত। নোনসিয়া সুন্দরী তো ছিলই। আর যে পোশাক সে পরিধান করত তাতে করে ওর দেহ সৌন্দর্য আরো বেশি করে ফুটে উঠত। যেমন একটি ভালো মদের তেজ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে তেমনটাই। যেমন বোতলের কাচটি যত পরিষ্কার, চকচকে হয় ভেতরের পানীয় ততই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কারণ বোতলের রং-রূপ যেন নেশাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। তখন এই নোনসিয়াকে দেখে মনে হয় সূর্যালোককে স্নান করে বেরিয়ে আসা এক যুবতী। সেও কিন্তু তার ওই রূপ সৌন্দর্যকে মেপে মেপে ব্যবহার করত। নিজের চেনা পরিচিত বয়স অনুসারী লোকদের সঙ্গে হাসি-মজা আর রসালো ভাষায় কথা বলত। আকারে ইঙ্গিতে প্রেম-ভালোবাসা, ভালো লাগা বুঝিয়ে দিত। তেমন নজরে তাকিয়ে পুরুষদের ঘায়েল করত। তাতে সেও আনন্দ পেত, উপভোগ করত। যেখানে এমন একটি যুবতী হাজির থাকে সেখানে পুরুষরা এগিয়ে না গিয়ে থাকতে পারে না। প্রায় প্রতিটা জোয়ান পুরুষ নিজেকে প্রদর্শন করতে চায়। নোনসিয়া এমনই এক আকর্ষণীয় আর গুণবতী নারী ছিল যে, সে তার ওই গুণের দ্বারা অনেকের অনেক রকম উপকার করেছে। সুপ্ত ক্ষমতাকে জাগিয়ে দিয়ে কত সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। প্রচ্ছন্ন, আচ্ছন্ন শরীরে প্রাণের সঞ্চার করে দিয়েছে নিজে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে। কারো সুপ্ত ইচ্ছাশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
আর এখন এত দিন পর তারই মেয়ে সব ধরনের গুণাবলি নিয়ে তার পাশে উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। ও যেন একটি বুনো বিড়াল। লোকে তাকে দেখে তাড়িয়ে তাড়িয়ে আর নিজ নিজ বিবেচনা দিয়ে ওদের রূপের পরিমাপ করার চেষ্টা করে।
এভাবে চলে যায় দিন-মাস বছর। মেয়ে দিন দিন মায়ের সমান সমান ভরাট হয়ে উঠতে লাগল। নোনসিয়া নিজের চেতনে অবচেতনে মেয়ের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে বসে আজকাল। পরক্ষণেই আবার নিজের ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নেয়। তখন মেয়েকে দেখে মাতৃস্নেহের নজরে। যেমন করে একজন জুয়াড়ি তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে সন্দেহ আর চোরা দৃষ্টিতে। পাশের খেলোয়াড়ের হাতে কোন তাস না জানি আছে!
এর পরও কেটে গেল আরো দুটি বছর। এখন মা-মেয়ে সমানে সমানে এসে গেছে। কিন্তু কোথাও যেন একটা অদৃশ্য দূরত্বও রয়েছে। তাই উঠতি যুবকদের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কার প্রতি প্রেমনিবেদন করা উচিত হবে—মাকে, নাকি মেয়েকে? নোনসিয়ার সহেলিরা কেউ কেউ এখন ওকে খোঁচা মারে, আঘাত দিয়ে কথা বলে। বলে, কী রে, এবার তো মেয়ের কাছে তোকে হার মানতে হবে। নোনসিয়া মুচকি হাসতে চেষ্টা করে জবাব দেয়, চাঁদ উঠেছে উঁচুতে, ভালো করে দেখলে বড় নক্ষত্রদেরই ঠিকই চেনা যায়।
নোনসিয়ার মাতৃস্নেহ মেয়ের প্রতি সর্বদাই ঝরে পড়ে। সে সবটুকুই মেয়েকে দিতে যায়। তবে একজন রূপ গরবিনী নারীর দৃষ্টিতে সে মেয়ের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করতে শুরু করেছে। কারণ তার মেয়ে নীনা এখন পূর্ণরূপে সূর্যালোকে এসে দাঁড়িয়েছে। মাঝখানে রয়েছে মা একদিকে, সূর্যালোক একদিকে। গায়ে ছায়া পড়া পছন্দ করছে না নোনসিয়া। মেয়ে বলে, মা, তুমি যদি আর একটু নিজের সম্বন্ধে সচেতন থাকতে, তাহলে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।
আর এক দিন তো মেয়ে মাকে বলে ফেলল, তুমি দেখছি আমাকে পেছনে রাখতে চাইছো। তাহলে এখন এত বছর আগলানোর মানে কী, আমাকে সাবধানে রাখো? নাকি সবার সামনে যেতে না দেওয়া। আমি এখন সব বুঝি মা। এখন আর আমি তত ছোট মেয়েটি নেই। আমার বুকেও অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা জমেছে। আমিও আমার ইচ্ছানুসারে বাঁচতে চাই। তুমি তোমার সময়কালে খুব রঙিন জীবনযাপন করেছিলে। আমার কি এখন মনপ্রাণ খুলে চলাফেরা করার দিন আসেনি?
আর কিছু বলার আছে?
এরপর মেয়ে আর কথা বলল না। অপরাধীর মতো মুখ করে মাথা নিচু করল। কারণ সে জানত, আর বিশেষ কি বলার ছিল।
এক দিন একটা লোক এলো ওদের বস্তিতে। লোকটা চলে গিয়েছিল এক দিন অস্ট্রেলিয়া দেশে কাজ করতে। তার নাম আনরেকা বোরবো। এখন কিছুদিনের জন্য এসেছে দেশে। আবার চলে যাবে। ও যেখানে থাকে সেখানকার জীবনধারার সঙ্গে এখানকার জীবনে অনেক পার্থক্য। ওর বয়স এখন ছত্রিশ বছর। এমনিতে হাসিখুশি স্বভাবের মানুষ সে। আচরণে প্রফুল্ল, বেশ প্রকট। সে এখানে এসে তার জঙ্গলের গল্প করে বেশ মজা করে। লোকে বুঝতে পারে, ও কিছু সত্য আর কিছু বানিয়ে বানিয়ে গল্প করে যায়। আর তার সঙ্গে এই মা-মেয়ে দুজনেই লোকটার সমস্ত গল্প একমনে গিলতে থাকে—সবই সত্যি ভেবে।
নীনা বাড়ি ফিরে মাকে বলতে থাকে, আমি বুঝতে পারছি আনরেকোর আমাকে খুব পছন্দ। কিন্তু আমিও দেখেছি তুমিও তাকে সায় দিয়ে যাও। ফলে সে বেশ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। আর সেটাই আমার পছন্দ নয়। আমি এসব বুঝতে পারি।
আসলে এই প্রবাদই সত্য যে, সহজে কোনো আকাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে গেলে মানুষ আত্মহারা হয়ে যায়। আর এটা হয়, যখন সে লোকটা কাঁচা কিংবা উঠতি বয়সের হয়ে থাকে।
নীনার কথাবার্তা-আচরণ এখন যা চলছে, তা নোনসিয়া কখনো কল্পনা করেনি। হবে ভাবেনি। ‘সান্স্যা কামো’ উৎসবের দিন সকাল থেকেই সবাই আনন্দে আছে। নাচে-গানে মুখর হয়ে আছে ওদের বস্তি। নোনসিয়া-নীনাও আছে। নাচ শেষ হওয়ার পর সে সবাইকে শুনিয়ে তার মাকে বলল, মা, তুমি কিন্তু আজ দরকারের চেয়ে বেশি নেচেছো। বেশি বেশি করছো কিন্তু। তোমার মতো বয়সের নারীদের পক্ষে এত নাচা ভালো দেখায় না। তোমার শরীর-মন এখন আর এর উপযুক্ত নেই।
সেখানে উপস্থিত সমস্ত নারী-পুরুষ নীনার নরম স্বরে কিন্তু অভদ্র শব্দের কথাগুলো শুনে হতবাক হয়ে গেল। পরক্ষণেই নোনসিয়া রেগে গিয়ে অস্থির হয়ে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, ও! তুই আমার বুকের জোরের চিন্তা করছিস! আমার জন্য তোর এত চিন্তা? ঠিক আছে বেটি। আজ দেখব কার বুকে কত শক্তি আছে? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নোনসিয়া একটি প্রস্তাব পেশ করল সমবেত জনতার সামনে। বলল, আমি এখান থেকে ওই ফোয়ারা পর্যন্ত তিনবার দৌড় লাগাব। মাঝে না থেমে। তুমিও দৌড়াবে আমার সঙ্গে।
অনেকের মনে হলো এটা সম্পূর্ণ অর্থহীন। তাই অনেকের কাছে বেশ লজ্জাজনক ব্যাপার মনে হতে লাগল। আর কিছু লোকের নোনসিয়ার প্রস্তাব নাকচ করতে বলার মতো মানসিকতা না থাকায় অনুমোদন করে উৎসাহিত হয়ে উঠল। তাদেরও আশা, নীনা যেন ওর মায়ের ‘চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করে। সব ব্যবস্থা করা হলো। বিচারক মনোনীত করা হলো। অনেকে কিন্তু চাইছে, মায়েরই জিৎ হোক। তারা মনে মনে তাই প্রার্থনা করছে।
মা আর মেয়ে দাঁড়াল। প্রস্তুত হলো দৌড় শুরু করার জন্য। কেউ কারো দিকে তাকাবে না। দৌড় শুরু করার জন্য ঘণ্টা বাজালেন বিচারক। ছুটল মা ও মেয়ে। যেন দুটি বড় আকারের সাদা কোনো পাখি ছুটছে ওই চৌমাথার দিকে। মায়ের মাথায় বাঁধা আছে লাল রুমাল। আর মেয়ের মাথায় হালকা নীল রঙের রুমাল বাঁধা।
দৌড় শুরুর একটু পরে সবাই দেখল, মায়ের ছোটার গতি মেয়ের চেয়ে অনেক তেজি। নোনসিয়া ছুটছে যেন সে ধরণির সঙ্গে আলিঙ্গন করতে চাইছে প্রবল আবেগে। রাস্তার দুপাশের বাড়ির জানালা খুলে আরো কত নারী-পুরুষ দেখছে। তারাও চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে।
প্রথম দৌড়টা শেষ হলো। দুজনের মধ্যে তফাৎ বেশি ছিল না। তারপর দ্বিতীয় দৌড় হলো। এবার মা চার মিটার এগিয়ে ছিল। মেয়ে পরিশ্রমে ক্লান্তিতে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে গির্জার সিঁড়ির কাছে শুয়ে পড়ল। দেখা গেল তৃতীয়বারে দৌড়ানোর ক্ষমতা নীনার আর নেই। নোনসিয়াকে দেখাচ্ছে বিজলির চমকের মতো। সে এগিয়ে গিয়ে মেয়ের ওপর ঝুঁকি দেখে নিয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। তারপর মেয়ের চুলের একটি গোছা মুঠো করে ধরে বলল, এই মেয়ে, তুই কি জানিস—খেলা, কামনা আর প্রেমের ক্ষেত্রে খুব মজবুত বুক চাই। আর সে বুক, সে রকম নারীদেরই থাকে—যারা জীবনের প্রতিটি পরীক্ষা পার হয়ে এসেছে। তবে সেটা হবে তিরিশের ওপর বয়স হওয়ার পর। দুষ্টু কোথাকার!
মেয়ের কাছ থেকে সরে এলো নোনসিয়া। তারপর আর একটুও না জিরিয়ে, না বসে, সে বাজনদারদের বলল, বাজাও তোমরা। কে নাচবে আমার সঙ্গে?
অনরেকো এগিয়ে এলো। সে প্রথমে নিজের টুপি খুলে ঝুঁকে অভিবাদন করল ওই তেজোময়ী, বিজয়িনী নারীকে। বাজনদাররা দারুণ উত্তেজক, উন্মাদনা সৃষ্টিকারী সুরতালের বাজনা শুরু করল। নোনসিয়া নাচতে শুরু করল। কখনো সর্পিণীর মতো হিলহিলে। কখনো এক রূপসী লাস্যময়ী নারীর জ্বালাধরা আবেগের চরম প্রকাশ দেখল। তার নাচে নিজেকে অপরাজেয় রাখার বাসনায় অধীর হয়ে আছে সে। বারবার তার নাচের সঙ্গী বদল হচ্ছে। সাথিরা ক্লান্ত হয়ে সরে যাচ্ছে। নোনসিয়ার নেই কোনো ক্লান্তিশ্রান্তি।
রাত্রি অনেক হয়ে গেছে। নোনসিয়া অবশেষে অনরেকোকে আহ্বান জানাল আবার। এবার দুজনে ধীর লয়ে নাচতে শুরু করল। একবার হঠাৎ নোনসিয়ার আর্তস্বর বেরিয়ে এলো।
অনরেকো দেখল, নোনসিয়াকে আলাদা রকম দেখাচ্ছে। এ মুহূর্তে ওর চোখ দুটি বিস্ফোরিত। প্রেমাসক্ত দৃষ্টি। অমন অবস্থায় সে দুটি হাত ওপরে তুলল। আর ওইভাবেই মাটিতে পড়ে নীরব নিশ্চল হয়ে গেল।
ডাক্তার আনা হলো, তিনি পরীক্ষা করে বললেন—ও মারা গেছে। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে…।