কেন কবিতা লিখি
আমি এবং কবিতা যেন পারস্পরিক আয়না। কবিতাতেই নিজেকে হারাই, খুঁজে পাই, নিজেকে জানি। কবিতার সঙ্গে জন্মসূত্রেই গাঁটবন্ধন। এ বন্ধন অবিচ্ছেদ্য—‘আয়না এবং আমি নিজের দিকে তাকিয়ে/আমার ভেতরের কেউ/নীরবতার দেয়ালে আঁচড় কেটে বলল,/‘অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ মানুষ/নিজেই নিজের আয়না’…।
এখন আর বুঝতে পারি না— কবে পরিচয় কবিতার সঙ্গে, কবেই বা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছি। শুধু এটুকু বুঝি, কবিতা আমার টুকরো কিংবা সমগ্র জীবন। কবিতা আমার আকাশ, যার নিচে আমি বসবাস করি, কবিতা আমার বায়ুমণ্ডল, যেখানে গচ্ছিত আমার শ্বাস-প্রশ্বাস, আমার বেঁচে থাকা।
কখনো মনে হয়, কবিতা আমার নিজস্ব ছায়া, যাকে অনুসরণ করে চলছি। যার বৃত্তে আবদ্ধ আমি প্রতিনিয়ত অন্তরের সংকটগুলো শব্দে-ছন্দে-দীর্ঘশ্বাসে মুড়িয়ে পঠন, শ্রবণ ও দর্শন গ্রাহ্য করে দিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি থেকে আবার নতুন চেতনা, নতুন বোধ গ্রহণ করছি। লালন করছি, দোহন করছি কামধেনুর দুগ্ধসুধা, যা আমাকে সঞ্জীবিত করবে। এ এক দারুণ খেলা! এ শুধু তখনই পাওয়া যায়, যখন কবিতার অনাবিল আনন্দ-ধারায় স্নান করা যায়।
কখনো কবিতা এবং আমি সমান্তরালে চলছি, কখনো আমরা পরস্পরের ভেতরে পরিভ্রমণ করছি। এ ভ্রমণের শেষ নেই, অন্তহীন চলা,অন্তহীন আনন্দ, অন্তহীন রোদন।
আমার জীবনের সত্যগুলোই কবিতা হয়ে যায়
কবিতার সঙ্গে ঘর-সংসার খুব একটা কম সময়ের না। তাই বুঝি, ওকে আর খুঁজতে হয় না। ও এখন আমার জীবনেরই উচ্চারণ, আমার অন্তরস্থিত প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তির ধ্বনিময় ছন্দ, আমার জীবনবোধ। তাই আমার কাছে কবিতা ‘স্বকীয় ভাষায় অনুদিত এবং পোড়া হৃদয়ে অংকুরিত বনসাই প্রেম…’, যা একান্তই আমার, অনুযোগ এবং অভিযোগের সীমানা ছাড়ানো, প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির অমিল হিসেব।
আমার জীবনের সত্যগুলোই কবিতা হয়ে যায়। আমি এবং আমার কবিতার মধ্যে কোনো আড়াল নেই। যা আমি ভাবি, তাই নির্বিচারে বলে যাই কবিতায়, বলে যাই ছন্দে-আনন্দে-ক্রন্দনে। আমার দহন, আমার যাপন, আমার ভবন—এর সবটুকুই জুড়ে আছে কবিতা। কবিতার সঙ্গে ঘরবসতি বড় আনন্দের।
যিনি কবি তিনিই সাধক, কবিতাকে সাধন করতে হয়। সাধনার মাধ্যমেই বোধের দরজা খুলে এগিয়ে যেতে হয়। অনুভূত হয় দহনের অপার আনন্দ, বেদনার শ্রাবণধারা। এভাবে এগিয়ে যেতে যেতে আমি ‘মাথা উঁচু করে আকাশ দেখি, নিজেকে দেখি সপ্তর্ষীমণ্ডলের পাশে’।
তাই বলতে পারি, কবিতা আমার সাধন করে অথবা আমিই কবিতার সাধন করি। এভাবেই না-হয় পারস্পরিক যুগলবন্দিত্ব চলতে থাকুক অনন্তকাল, অনন্তপথ, জন্ম থেকে জন্মান্তরে।
তিনটি কবিতা
নীরবতার ছায়া
নীরব হলেই
অবশিষ্ট কথার ছায়া পড়ে তোমার চোখে
অকাল বৃষ্টিতে স্নান করে
ওরা ছুটে আসে আমার কাছে
পরম আদরে তাদের বুকে তুলে রাখি
আমাদের মাঝে থাকে
শুধুই
বৃষ্টিভেজা নীরবতা…
নীরব হলেই কথারা জড়ো হয় তোমার চোখে…
মাটির সাথে সম্পর্ক
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথাগুলো বলতে বলতে
ঘাসে মুখ গুঁজে আছি
সবকিছু হারানোর শেষে
নিজেকেই হারাতে চেয়েছি মৃত্তিকায়
ছোটবেলার মাটির পুতুল হয়ে ভুলতে চেয়েছি
না-পাওয়ার গল্পগুলো
সবকিছুই হারাতে হারাতে জেনেছি
মাটির সাথে মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য
এভাবেই ঘাসে মুখ গুঁজে বসে আছি অনন্তকাল…
অলঙ্ঘনীয়
সবকটি বোতাম খুলে
হৃদয়ের উত্তাপ দাও
চোখে চোখ রেখে ছুঁয়ে থাকো হাত,
ভুলে যাও প্রতিক্ষণ
বয়ে যাক রাত
মনে করো…
সব ঘড়ি থেমে গেছে
অথবা
এ শহরে ঘড়ি বলে কিছু নেই,
রূপকথার গল্পটা
একান্ত আমাদের
তুমি বোতাম খোলো
আমাকে পড়তে দাও
সুবিন্যস্ত অক্ষরে লেখা
ভালোবাসার মহাকাব্য,
রূপকথার গল্পটি শুধু আমার,
তোমার এবং
আমাদের…
শেলী সেনগুপ্তা। কবি ও কথাসাহিত্যিক। সম্পাদক ‘একান্নবর্তী’। জন্ম ৫ মে, পাহাড় ও সাগরকন্যা চট্টগ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং শিক্ষা ও গবেষণায় স্নাতক। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশুতোষ ও প্রবন্ধের বই ৫০টি। দেশে-বিদেশে বহু সম্মাননাপ্রাপ্ত এ লেখকের সাহিত্যচর্চা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। যোগাযোগ : sengupta_shelly@yahoo.com