প্রবন্ধ

ইতিহাস-ঐতিহ্য

কলাগাছের ভেলা বা বোরহা

আলমগীর খোরশেদ

বর্ষায় গ্রামের জল টইটম্বুর জনপদে বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কলাগাছের ভেলা বা ‘বোরহা’।

আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ জনপদের দুরন্ত কিশোররা বর্ষণমুখর পরিবেশে সদ্য প্লাবিত নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় কিংবা তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমিতে ছুটে যেত মাছ ধরতে। অবস্থাসম্পন্ন যারা তারা নৌকায় চড়ে এদিক-সেদিক, প্রতিবেশী, হাটবাজার, আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়া-আসা করে আত্মীয়তা বজায় রাখতেন। গরিব পরিবারের লোকরা কলাগাছ দিয়ে বানানো ভেলা বা আঞ্চলিক ভাষায় ‘বোরহা’য় চড়ে তাদের প্রয়োজন মেটাত। পুরোনো দিন বর্ষাকালে একটানা সাত-আট দিন বৃষ্টির ফলে গ্রামে পুকুর, নদী, খাল-বিল সব পানিতে তলিয়ে যেত। পারিবারিক, সামাজিক, গৃহস্থালি, কৃষি ও দৈনন্দিন জীবনের কাজ থমকে যেত পানির জন্য। কোনো কাজকাম থাকত না বিধায় গরিব মানুষরা খেয়ে না-খেয়ে কাটিয়ে দিত। চালের খুদ বা কাউনের জাউ, কাঁঠালের বিচি তাওয়ায় পুড়িয়ে খাওয়ার বাঙালিয়ানা ছিল অনেক সমাদৃত। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা বড়দের তাগাদা দিত—চলাচলের জন্য কলাগাছ কেটে তা দিয়ে ভেলা বা বোরহা বানিয়ে দিতে। চারপাশের পানির রাজ্যে তখন ভেলা বানানোয় ধুম পড়ে যেত। ভেলা একটি সরল কাঠামোর তৈরি জলযান। তখন ছোট নদী, খাল পারাপারে ভেলার ব্যবহার হতো। চার-পাঁচটা কলাগাছ, ক্ষেত্রবিশেষে কমবেশি, বাঁশের কঞ্চি বা শলাকা ঢুকিয়ে গেঁথে পাশাপাশি দড়ি দিয়ে বেঁধে কলাগাছ দিয়ে বানানো হতো ভেলা। সাপে কাটা রোগীকে কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ পাশের দেশ ভারতে প্রচলন আছে। গ্রামবাংলার পুরোনো সাহিত্য মৈমনসিংহ-গীতিকায় ‘বেহুলা’ পালায় কলাগাছের ভেলায় চড়ে বেহুলা তার স্বামী লখিন্দরকে নিয়ে মনসা দেবীর উদ্দেশে পানিতে যাত্রার কাহিনির বর্ণনা আছে।

গ্রামে বর্ষাকালে ভেলায় চড়া একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতা দেয় মানুষকে

ভেলা বানাতে চার-পাঁচটি বা তারও বেশি কলাগাছ, বাঁশের কঞ্চি বা ফালি, দড়ির প্রয়োজন হয়। চালাতে লাগে লম্বা লাঠি, কুটা বা লম্বা মলি বাঁশ। এটা জল ছুঁইছুঁই করে জলের ওপর দিয়ে চলে, কিন্তু যা সহজে ডুবেও না। গ্রামে বর্ষাকালে ভেলায় চড়া একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতা দেয় মানুষকে। গ্রামে যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তাদের কেউ মনে হয় বাদ নেই যে, কলাগাছের ভেলা বানায়নি বা চড়েনি। ভেলায় চড়ে বিলে শাপলা তোলা, মাছ ধরা, জাল পেতে রাখা, গরিব লোকের জাহাজ হিসেবে পরিচিত ভেলা এদিক-ওদিক যাওয়া-আসার জন্য ব্যবহৃত হতো। বর্ষাকালে বাড়ির গৃহস্থের গরু, ছাগল, মানে গবাদিপশুর খাবার সংগ্রহ, কচুরিপানা কেটে আনা, আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া, হাটবাজারে যাওয়ার মাধ্যম ছিল কলাগাছের ভেলা। কম খরচে তৈরি করা যায় বলে বোরহা বা ভেলাকে গরিবের জাহাজ বলা হতো। ভেলায় চড়ে প্রতিযোগিতা বা ভেলার বাইচ হতো গ্রামের পুকুরে বা বিল, নদীতে। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থরা তালগাছ কেটে তার কাণ্ড খোদাই করে ফেলে দিয়ে বানিয়ে নিত ‘খোষা’। বিলে মাছ ধরা, গরুর খাবার কচুরিপানা বা জারমুনি কেটে আনতেন কৃষক। কলাগাছের ভেলা চালাতে লম্বা বাঁশ লাগে, আঞ্চলিক ভাষায় যাকে ‘কুটা’ বলে। কুটা দিয়ে মাটিতে চেপে চেপে ভেলা চালিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। যাদের বাড়ির সামনে পুকুর ছিল, সে বাড়ির ছেলেরা ভেলা বানিয়ে রাখত পুকুরে। স্কুল থেকে এসে বা গোসলের সময় কলাগাছের ভেলা বা বোরহা চালাত। এ নিয়ে ওদের বড়দের বকা খেতে হতো। ভেলার কলাগাছ আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যেত মানে পচে যেত। তখন মাছ ধরার কাজে কলাগাছ ব্যবহার করা হতো। মাটির সঙ্গে চেপে দুপাশে দুজন কলাগাছকে ঠেলিয়ে কিনারায় লাগিয়ে দুপাশে হাত দিয়ে ধরে রাখত, পানি চলে গেলে মাছ পাওয়া যেত। মাঝ পুকুর বা বিলে ভেলা রেখে ভেলার কলাগাছে বাঁশের কঞ্চি ঢুকিয়ে গামছা টানিয়ে ছই বানিয়ে নিচে বসে থাকার মজা যে পায়নি, গ্রামীণ জীবনের আরেকটা আনন্দ থেকে বঞ্চিত সে। বোরহা বা ভেলা ছোটবেলায় সাঁতার শেখায় সহায়তা করত। ভেলা দুহাতে চেপে ধরে পা পানিতে বাড়ি দিয়ে সাম্যতা বজায় রেখে সাঁতার শিক্ষা হতো।

লেখক

আজকাল ছেলেমেয়েরা ভেলা কি জিনিস জানে না। পুকুরও নেই আগের মতো। ভরাট করে জমি না হয় বাড়ি বানিয়েছে নতুন প্রজন্ম। ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে থেকে সময় পার করে আজকের ছেলেমেয়েরা। কলাগাছের মামুলি ভেলায় তাদের মন টানে না, সুখ পায় না। হাতের মুঠোয় বিশ্ব পেয়ে তারা মজে গেছে। আজ মধ্যবয়সি যারা, তাদের গ্রামে থাকা ছেলেবেলার স্মৃতিতে কলাগাছের বোরহা বা ভেলা জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে সকাল, দুপুর কিংবা সন্ধ্যায়।

 

লেখক পরিচিতি

আলমগীর খোরশেদ। কবি, গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক ও গবেষক। জন্ম ১৯৬৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়। শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক), এমএসসি ইন ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলোজি। বুয়েট পাওয়ার প্লান্টে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত বই ২৪টি। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবদান রাখায় পেয়েছেন বহু সম্মাননা। তিনি একজন সংগঠকও। যোগাযোগ : engr.alamgir.buet@gmail.com

Leave a Comment

বিজ্ঞাপন

সম্পাদক : মীর হেলাল । শিল্প নির্দেশক : বদরুল হায়দার । © 2023 পৌষ
editor@poushh.com । তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা । 01914 441 825