ইংরেজ বংশোদ্ভূত ভারতীয় লেখক রাস্কিন বন্ডের জন্ম হিমাচল প্রদেশের কসৌলিতে ১৯৩৪-এর ১৯ মে। ১৭ বছর বয়সে তিনি লেখেন প্রথম উপন্যাস The Room On The Roof। ১৯৯২ সালে ‘সাহিত্য আকাদেমি’ পুরস্কারে ভূষিত হন। ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান দেওয়া হয় তাকে ১৯৯৯ সালে এবং ‘পদ্মভূষণ’ ২০১৪-তে। বর্তমানে রাস্কিন বাস করেন মুসৌরিতে
রোহনায় যাওয়ার জন্য যখন আমি ট্রেনের কামরায় উঠলাম, ঠিক সে সময় মেয়েটিও উঠল। দম্পতি দুজন যারা মেয়েটিকে বিদায় জানাতে এসেছিল, তারা সম্ভবত তার মা-বাবা। মনে হলো, তারা অত্যন্ত চিন্তিত মেয়েটির স্বাচ্ছন্দ্য সম্বন্ধে। বিশেষত নারীটি মেয়েকে সবিস্তার নির্দেশ দিয়ে দিলেন—কোথায় মালপত্র রাখতে হবে, কখনো জানালা দিয়ে ঝুঁকবে না, অপরিচিত কারোর সঙ্গে কথাবার্তা এড়িয়ে চলবে।
তারা তাকে বিদায় জানাল আর ট্রেনটিও স্টেশন ছেড়ে গেল। যেহেতু আমি ছিলাম সম্পূর্ণভাবে অন্ধ, আমার চোখ দুটি কেবল আলো আর অন্ধকারের প্রতি সংবেদনশীল ছিল, আমি তাই বলতে পারব না মেয়েটিকে কেমন দেখতে ছিল। কিন্তু সে যে পায়ে চপ্পল পরেছিল, গোড়ালির সঙ্গে আঘাতের শব্দেই টের পেয়েছিলাম। কিছুটা সময় লাগত তাকে কেমন দেখতে উপলব্ধি করার ব্যাপারে, হয়তো তা পারতামও না। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আমার পছন্দ হয়েছিল আর তার চপ্পলের আওয়াজও।
আমি প্রশ্ন করলাম, তুমি দেহরা মানে দেরাদুন পর্যন্ত যাবে? আমি অবশ্যই কোনো অন্ধকার কোণে বসেছিলাম নতুবা আমার কণ্ঠস্বর শুনে সে কম্পিত হবে কেন। বিস্মিত হয়ে জানতেই বা চাইবে কেন—এখানে যে কেউ আছে জানতামই না। আসলে এমনটা হামেশাই ঘটে, ভালো দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন মানুষও দেখতে ব্যর্থ হয় তাদের সামনে ঠিক কী আছে। আমার মনে হয়, তারা অনেক কিছুই দেখে। আর যারা দেখতে পায় না বা ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন তারা কেবল অত্যাবশ্যকটুকুই গ্রাহ্য করে, এ ব্যাপারে তাদের অন্য ইন্দ্রিয়গুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে যা কিছু গ্রহণ করে।
বললাম, তোমায় দেখিনি কিন্তু আসার শব্দ পেয়েছি। আমি এভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করি তাকে বাধা দিতে, যাতে সে বুঝতে না পারে আমি অন্ধ।
মেয়েটি বলল, আমি সাহারানপুরে নেমে যাব। কাকিমা আসবে নিতে।
মনে হয় তোমার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ না হওয়াই ভালো, কেননা কাকিমারা বেশ জাঁদরেল টাইপের হন কি না।
তুমি কোথায় যাচ্ছো?
প্রথমে দেহরা, তারপর মুসৌরি।
তুমি কি ভাগ্যবান। অক্টোবরে মুসৌরি পাহাড় দেখতে খুব ভালোবাসি।
আমি স্মৃতি হাতড়ে বললাম, হ্যাঁ, অক্টোবরেই যথার্থ সময়। বন্য ডালিয়া ফুলে আচ্ছাদিত পাহাড়, আকর্ষণীয় সৌরছটা, আর্দ্র নিশীথে আগুনের আঁচ নিতে নিতে ব্রান্ডি পানের মজা। বেশির ভাগ ট্যুরিস্ট চলে গেছে আর রাস্তাঘাটও এখন শান্ত এবং নির্জন।
মেয়েটি নিশ্চুপ। আশ্চর্য হলাম, হয়তো আমার কথাগুলো তাকে স্পর্শ করেছে কিংবা আমাকে ভেবেছে কোনো আবেগপ্রবণ হাঁদারাম। এরপর একটা ভুল করে বসলাম
মেয়েটি নিশ্চুপ। আশ্চর্য হলাম, হয়তো আমার কথাগুলো তাকে স্পর্শ করেছে কিংবা আমাকে ভেবেছে কোনো আবেগপ্রবণ হাঁদারাম। এরপর একটা ভুল করে বসলাম। জানতে চাইলাম, বাইরেটা কেমন?
তুমি নিজেই জানালার বাইরে দেখে নিতে পারতে?
খোলা জানালার তাক ধরে বাইরের প্রকৃতির দৃশ্য দেখার ভান করলাম। ইঞ্জিনের ধকধক, চাকার ঘরঘর আর মনশ্চক্ষে টেলিগ্রাফ পোস্টগুলোর সাঁ সাঁ শব্দে পেরিয়ে যেতে দেখলাম। একটু সাহস করে বললাম, তুমি কি লক্ষ করেছো, আমরা স্থির হয়ে আছি আর গাছপালাগুলো কেমন সরে সরে যাচ্ছে? মেয়েটি বলল, এমনটা সর্বদাই ঘটে। আচ্ছা তুমি কি কোনো প্রাণী দেখতে পাচ্ছো? আমি বেশ আত্মবিশ^াসের সঙ্গে বললাম, না। আমি আসলে জানতাম দেহরার নিকটবর্তী জঙ্গলে কোনো বন্যপ্রাণী অবশিষ্ট নেই। জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এবার মেয়েটির মুখোমুখি হই। আমি বলি, তোমার মুখটা খুব সুন্দর। মেয়েটি মিষ্টভাবে হাসল। পরিষ্কার, খিলখিল হাসি হেসে বলল, এ কথা শুনতে ভালো লাগে যে, আমার মুখটা সুন্দর, কিন্তু লোকের মুখে এ কথা শুনতে শুনতে আমি যে ভীষণ ক্লান্ত।
ও, তাহলে তোমার মুখটা সত্যিই সুন্দর।
তুমি তো বেশ সাহসী যুবক, অথচ এত গম্ভীর কেন?
আমি তার জন্য অন্তত হাসতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু হাসির ভাবনা আমাকে বিপন্ন করে তুলল আর আমি একা হয়ে গেলাম। বললাম, শিগগিরই তোমার স্টেশন আসছে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এই সংক্ষিপ্ত যাত্রার জন্য। আসলে দু-তিন ঘণ্টার বেশি বসে থাকা আমার অসহ্য বলে মনে হয়। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর শুনতে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে পারি। যখন সে চলে যাবে আমাদের এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারের কথা সে হয়তো ভুলে যাবে, কিন্তু যাত্রাশেষের পরও আমার কাছে তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইঞ্জিনের বাঁশি বাজল আর মেয়েটিও তার মালপত্র নিয়ে নেমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। ভাবতে লাগলাম, সে কি তার চুলে খোঁপা বেঁধেছিল, নাকি বিনুনি করেছে, হয়তো তার কাঁধের ওপর খোলা চুল মেলে দিয়েছিল, নাকি চুল খুব ছোট করে কেটেছিল? ট্রেনটি ধীরে ধীরে স্টেশনে প্রবেশ করল আর তার কাকিমার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। মেয়েটি বলল, বিদায়। সে আমার খুব কাছে দাঁড়িয়েছিল আর তার চুলের সুগন্ধ আমাকে আবিষ্ট করেছিল। আমি তার চুল স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু সে চলে গেল। সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল তার চুলের সুগন্ধ একমাত্র সেখানে বহুক্ষণ থেকে গিয়েছিল।
হঠাৎ দরজার কাছে হইচই শোনা গেল। একজন যাত্রী কামরায় উঠে অস্পষ্ট স্বরে ক্ষমা চাইল। দড়াম করে সশব্দে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল আর বাইরের জগৎটাও সেই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হলো। গার্ড সাহেব বাঁশি বাজালেন আর আমরাও চলতে শুরু করলাম। আরো একবার নতুন সহযাত্রীর সঙ্গে খেলায় মেতে উঠলাম। ট্রেনের গতি বাড়তে থাকল। আমি জানালার সামনে গিয়ে বসলাম। বাইরের দিনের আলো দুচোখে অন্ধকার ছড়িয়ে দিল। জানালার বাইরে কী কী ঘটে চলেছে, সেসব অনুমানের মধ্যেই আছে আমার খেলার আকর্ষণ ও মজা। সহযাত্রীটি দিবাস্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটাল। সে বলল, তুমি নিশ্চয় হতাশ হবে, এইমাত্র যে নেমে গেল তার মতো আকর্ষণীয় সফরসঙ্গী আমি নই। আমি বললাম, মেয়েটি দারুণ আকর্ষণীয় তাই না? আচ্ছা, তুমি বলতে পারো, সে লম্বা চুল রেখেছে না ছোট করে কাটা চুল? হতচকিত কণ্ঠস্বরে সে বলল, ঠিক মনে করতে পারছি না। আমি তার চোখ দুটোই লক্ষ করেছিলাম, তার চুল নয়। তার চোখ দুটো সুন্দর কিন্তু তা কোনো কাজেই লাগে না। কেন তুমি দেখোনি? ও যে সম্পূর্ণ অন্ধ।