অনেকের মতো আমারও লেখার শুরুটা ছড়া দিয়ে। তাই ছড়া পড়তে ও লিখতে এখনো খুব ভালোবাসি। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সঙ্গেও যুক্ত। লেখক হওয়ার নেশা আমায় পেয়ে বসেছে। তাই জড়িত হই বহুল প্রচারিত সংবাদের খেলাঘর পাতার সঙ্গে। প্রতি মঙ্গলবারে প্রকাশিত হয় ২ পৃষ্ঠায় পাতাটি। মাঝেমধ্যে নবীন লেখক বিবেচনায় ছড়িয়ে দিলাম ছড়া কলামে আমার ছড়া ছাপা হয়। তাও আবার এক কলাম! শিশুতোষ গল্পও প্রকাশ হয়। তবে তা একাধিক কলামে। কিন্তু খেয়াল করি আমার প্রকাশিত লেখা তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। মনে মনে ভাবি খেলাঘর করি। বিনা পারিশ্রমিকে পাতায় কাজ করি অথচ আমি কি না গুরুত্বহীন! বংশালে পাতার কাজ সেরে জগন্নাথ হলে ফিরি। প্রায়ই এই কষ্টটুকু সম্পাদনা পরিষদের বন্ধুদের বিনিময় করতাম। দাপুটে ছড়াকার হলবন্ধু অমিতাভ দাশ হিমুন সান্ত্বনা দিত! বলত ‘হবে হবে ডিসি ছড়া ছাপা।’ আর গল্পকার নীতিশ সাহার অভিমত, যে প্রাপ্তি দেরিতে আসে তা হয় টেকসই বন্ধু।’ মনে পড়ে সেই সময়কার উন্নত প্রগতিশীল কাগজ দৈনিক সংবাদ-এ খেলাঘরের পাতায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মানিক দের সুনিপুণ অলংকরণে দুজন ছড়াকারের ওই ফেব্রুয়ারিতে দুবার ডিসি (দুই কলাম) ছড়া প্রকাশিত হয়। একজন আলতাফ আলী হাসু অপরজন নাসের মাহমুদ। বিশিষ্ট গীতিকার ও ছড়াকার আলতাফ আলী হাসু ভাইকে চিনতাম, কেননা তিনি নয়াপল্টনের খেলাঘর কার্যালয়ে নিয়মিত আসতেন। দীর্ঘ সময় বিকালে আমার পরিচালনায় খেলাঘরের পাক্ষিক সাহিত্য বাসরে তিনি শানিত ছড়া পাঠ করতেন। কিন্তু বলিষ্ঠ এবং ছন্দময় ছড়াকার নাসের মাহমুদের সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় ছিল না। অপেক্ষায় থাকি সাহিত্য বাসরে নাসের মাহমুদের আগমনের। সশরীরে তার সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও নাসের মাহমুদের সৃজনশীল বক্তব্যধর্মী ছড়া আমাকে এমন পরিচিতি দিল তিনি যেন বহুদিনের চেনা মানবিক মানুষ।
এর মধ্যে অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। কিন্তু নিভৃতচারি ছড়াশিল্পী নাসের মাহমুদের সাক্ষাৎ আর মিলে না! তাই খেলাঘর পাতায় দ্বৈত কলামে (ডিসি) স্থান পাওয়া স্বরবৃত্তে ওনার ছন্দিত শব্দগুলো শুধু দেখি আর তা মগজে নেই!
হিসাবশাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর সনদপ্রাপ্তির পর নব্বইয়ে অর্জিত শিক্ষার ব্যবহার শুরু হয়ে যায় কর্মক্ষেত্রে। ব্যস্ত হয়ে পড়ি হিসাব-সম্পর্কিত পেশায়। কিন্তু মনে মনে খুঁজে ফিরি ছড়াকার নাসের মাহমুদকে প্রবলভাবে। হিসাববিজ্ঞান পেশার পর যুক্ত হই রাজধানীতে মূলধারায় সাংবাদিকতায়। কিন্তু লেখালেখিতে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তবে নাসের মাহমুদের গ্রন্থভুক্ত ছড়াগুলো পড়ি অনেক পরে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে। আমার কন্যা প্রমিতি মজুমদার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যে বছর মেয়েদের জন্য প্রখ্যাত দেশের বিদ্যাপীঠ ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হয় সেবার। এ সময় বের হয় সিদ্দিকীয়া পাবলিকেশন থেকে নাসের মাহমুদের ছড়ার বই— ছড়া সব করে রব। প্রথম শ্রেণির বিদ্যার্থী মেয়ের জন্য ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৬ ফর্মার বইটি কিনে আনি। ছয় বছরের শিশুকন্যাকে বই থেকে কটি ছড়া শুনিয়ে গৃহে রব করি আমি। আহা পঠনের কী আত্মসুখ!
১৯৮৩ থেকে ২০১৮। বহু সময়ের পথচলা। ৩৫ বছর পর অবশেষে ছড়াশিল্পী নাসের মাহমুদের দেখা মিলে এক দিন। মহানগরীর মোহাম্মদপুর বাবর রোডে অবস্থিত খেলাঘরের সাহিত্য বাসরের অনুষ্ঠানে। সম্ভবত সময়টা ছিল ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বর বিকালে। ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও গবেষক বিলু কবীরকে সঙ্গে করে সাহিত্যের আড্ডায় মিলিত হলেন স্বপ্নের সেই ছন্দিত ছড়াকার নাসের মাহমুদ। মাদুরের বিস্তীর্ণ আসনে সেদিন আরো বসা ছিলেন ছড়াকার সিরাজুল ফরিদ, কথাসাহিত্যিক, কবি ও গবেষক অমল সাহা, লেখক অরণ্য রেজা, সুরাইয়া আক্তার চিস্তি রীমা, নীলুফার নীলু, ছড়াকার সৌমেন পোদ্দার, সংগঠক রুনু আলী প্রমুখ। নাসের মাহমুদ ও বিলু কবীরের মতো আমিও সাহিত্য আসরে পঠিত লেখার ওপর আলোচনা করি। খেলাঘর সাহিত্য বাসরের প্রথা অনুযায়ী উপস্থিত লেখকদের সংগ্রহে আনা অর্থে হালকা ভোজনপর্ব সমাপ্ত হলো! অনুষ্ঠান শেষে ছড়াকার সিরাজুল ফরিদ ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন নাসের মাহমুদের সঙ্গে। মিতভাষী ও সৌম্য এই কবি ও ছড়াকার। মনকে প্রশ্ন করলাম, যিনি ছড়ায় করেন রব তিনি কেন নীরব? পরে জানলাম তিনি অসুস্থ অনেক দিন ধরে। হৃদয়ের টান ও ভালোবাসায় খেলাঘরের সাহিত্য বাসরে তিনি উপস্থিত হয়েছেন। বললাম আপনাকে খুঁজে বেড়াই ১৯৮৩ সাল থেকেই। তার ছড়া আমার ভালো লাগে তা জেনে স্মিত হাসি দিলেন তিনি। ‘গোলপাতা লম্বা’ ছড়াগ্রন্থের ‘মায়ের মানিক’ ছড়াটির বিষয় আমাকে বেশ ভাবিয়েছে! কাঁদিয়েছেও! ৮ পঙক্তির সেই কষ্টের ছড়াটি আওড়াতে থাকি তখন…
‘করতে স্বাধীন ছেলে গেছে/দেশ ডেকেছে ভাই—/জায়নামাজে মা বসেছে/খোদার রহম চাই।/সোনার বাংলা স্বাধীন হলো/মায়ের মানিক কই?/শহীদ হয়ে মায়ের মানিক/ঐ পতাকায় ওই।’
মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগী সন্তানরা জড়িয়ে আছে দেশের লাল সবুজের পতাকায় এই অনুভূতির বর্ণনা তাকে তাৎক্ষণিক বিস্মৃত করল মনে হলো। শুধু বড় বড় চোখে তাকালেন সৌম্য এই পুরুষ। জীবনবোধসম্পন্ন প্রগতিমনা এই ছড়াশিল্পীর গোলপাতা লম্বা গ্রন্থের প্রথম ছড়াটি বিশিষ্ট জাদুশিল্পী জুয়েল আইচকে নিয়ে লেখা। ‘ম্যাজিক’ ছড়ার বিষয়বস্তু। আমার পাঠে এ ছড়াটি রয়েছে শুনে খুশি হলেন নাসের ভাই। এরপর থেকে তার সৃজনী প্রতিভা নিয়ে পাঠ বিশ্লেষণ করি। তথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাই তার মননের বিশাল পরিধি। এরই মধ্যে পড়া হয় তার রচিত বিশাল ‘ছড়াসমগ্র-১’ এবং অতিশয় ছোট ‘দুরবো এষের ছড়া’ বইটি।
ছড়াকার নাসের মাহমুদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কুষ্টিয়া এবং সে গণ্ডি পেরিয়ে তার তির্যক ছড়াগুলো ঢাকা পর্যন্ত যে প্রতিবাদী বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল তা তার সমসাময়িক কবি, ছড়াকাররা খুব কমই করতে পেরেছিলেন। তার রম্য, মিঠেকড়া ছড়া এ দেশের সাহিত্যের ছড়া শাখাকে শুধু সমৃদ্ধি করেনি, সৃষ্টি করেছে নতুন এক সৃজনশীল ক্ষেত্র। তার কবিতার হাতটিও ভিন্ন আঙ্গিকের।
নাসের মাহমুদ ছড়া রচনার শুরু সত্তর দশকে। শুরু থেকেই বৈচিত্র্যের স্বাদ জুগিয়েছে তার ছড়া। ছড়া কুশলী কারিগর তিনি। ছড়া যেমন পড়েছেন, তেমনি গড়েছেনও। আধুনিক ছন্দের আর অন্ত্যমিলের নতুনত্বে তার দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। জীবনের সিংহভাগ সময় তার কেটেছে কুষ্টিয়ায়। সেখানকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অত্যন্ত পরিচিত মুখ ছিলেন তিনি। মুক্তমনা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গেও তার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা। একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবেও তিনি সফল। জন্ম তার ১৯৫৬ সালের ১ জুলাই রাওয়ালপিন্ডি। পৈতৃক বাড়ি রাজবাড়ীর পাংশায়। ভাতশালা গ্রামে। প্রথমে নিজ গ্রাম, পরে নানাবাড়ি চাঁদপুরের মতলবে (ধনাগোদা তালতলী)। তারপর ঢাকায় লেখাপড়া করেছেন। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির চাকরি করেছেন বিভিন্ন জেলায়। সাংবাদিকতাও করেছেন। ব্যবসা সূত্রে ভ্রমণ করেছেন হংকং, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, ম্যাকাউ, ভারত ও নেপাল। পিতা শাহ লুঙ্কর রহমান বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা ও কশবা মাজাইল ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিও কবিতা লিখতেন। নাসের মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ‘যে তুমি একমাত্র আমার’ প্রকাশ হয় ১৯৮৭ সালে।
নাসের মাহমুদ ছড়া সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্মৃতি পদক ও বিশেষ সম্মাননা ২০১৪ লাভ করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তার ২৮টি। ছড়ার বই ১২টি, কবিতা ও ছড়া কাহিনির বই একটি করে, সম্পাদিত বই ১০টি এবং পাঁচজনের একত্রে ছড়ার বই ৪টি। ক্রমানুসারে ৪টি বইয়ের নাম পঞ্চপাণ্ডব।
আধুনিক বাংলা কবিতায় পঞ্চপাণ্ডবের কথা আমরা অনেকেই জানি। তবে আমাদের ছড়া সাহিত্যে পাঁচ পাণ্ডবের প্রকাশিত স্বীকৃতি হিসেবে এই পরিচিতি অনেক পাঠকের কাছে কম থাকতেই পারে। পঞ্চপাণ্ডব শিরোনামে ৪টি সম্পাদিত গ্রন্থে ছড়াকার ও কবি নাসের মাহমুদও রয়েছেন। বাকি পাণ্ডবরা হলেন আলী হাবিব, বিলু কবীর, শফিক ইমতিয়াজ ও আহসান মালেক। এদের অধিকাংশ দেশের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। ছড়াকার হিসেবে তাদের অবদান কম নয়।
ডেস্কটপের কি-বোর্ডে যখন লিখছি, তখন ৩ এপ্রিল পার হয়ে আজ দুদিন। ক্ষণজন্মা প্রকৃতি, সমাজবাদী ও প্রতিবাদী ছড়াকারের প্রথম প্রয়াণ দিবস নীরবেই চলে গেল! আমার জন্মদাতা পিতা বলতেন, গুণী ব্যক্তির প্রধান শর্ত হলো— তাকে ভালো মানুষ হতে হবে। নাসের মাহমুদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। ভালো মানুষ বলেই সৃজনে তিনি ছিলেন উত্তম ব্যক্তি। সমকালের বাস্তবতা হলো, সৎ ও ভালো মানুষ বেশি দিন আয়ু পান না। তা ছাড়া, আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের মতো গুণী মানুষের সম্মান বা স্বীকৃতি তেমন কোথায়? ৬৪ বছর তেমন কী কার বয়স! তার চিরপ্রস্থান ছিল অতি নীরবে! অথচ সমাজ গঠনে এবং ‘শিক্ষিত’ মানুষদের ঘুম তাড়াতে তার নিরলস ছড়াশিল্পের অবদানকে আমরা ছোট করেই দেখেছি।