মেক্সিকোর সিটি পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক দম্পতি। তাদের হাতে ঢাউস সাইজের এক পাণ্ডুলিপি। পাণ্ডুলিপিটি পাঠানো হবে ‘সুদ আমেরিকানা’ নামের একটি দক্ষিণ আমেরিকান পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের অফিসে। একটু আগেই পোস্ট অফিসের কর্মচারী পাণ্ডুলিপির প্যাকেটটি দাঁড়িপাল্লায় মেপে জানিয়েছে, প্যাকেটটি পাঠাতে বিরাশি পেসো লাগবে। কিন্তু এই দম্পতির কাছে সর্বসাকূল্যে আছে মাত্র তিপান্ন পেসো। এই দম্পতি আর আর কেউ নয়, তারা ছিল মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। তাদের হাতে থাকা প্যাকেটের ভেতর ছিল ‘সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। যেটাকে আমরা আমাদের ভাষায় ‘নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর’ নামে চিনি।
সেদিনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে মার্কেস লিখেছেন, ‘আমরা প্যাকেটটা খুলে দুটো সমান ভাগে ভাগ করলাম কাগজগুলো। একভাগ পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দিলাম, আরেকভাগ রাখলাম নিজেদের কাছে। একবারও নিজেদের জিজ্ঞেস করলাম না যে, বাকিটা পাঠানোর টাকা আমরা কোথায় পাব? প্যাকেটটা পাঠিয়ে দেওয়ার পরেই আমরা খেয়াল করলাম, প্রথম অর্ধেকের জায়গায় দ্বিতীয় অর্ধেকটা পাঠিয়ে দিয়েছি।’
নিঃসঙ্গতার ১০০ বছরের যাত্রা শুরু হয়েছিল এভাবেই। এই বই বের হওয়ার আগে মার্কেসের কোনো বই ৭০০ কপির বেশি চলেনি। এই বই প্রথম দফাতেই প্রকাশক যখন ৮ হাজার কপি ছাপাতে চেয়েছিলেন, তখন বেশ ভড়কে গিয়েছিলেন মার্কেস। তবে প্রকাশক বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি সঠিক জায়গায় লগ্নি করছেন। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস এরপর ছাড়িয়ে গেছে পৃথিবীর অনেক রেকর্ড। মার্কেসকে নিয়ে গেছে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এখন অব্দি এই উপন্যাস ৪৬টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং ৫০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।
নিজস্ব মিথ, জাদুবাস্তবতা আর লৌকিক পুরাণের যৌগিক মিশেলে তৈরি ‘নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর’ গল্পের পরিধি ছাড়িয়ে রূপান্তরিত হয়েছে মহাকাব্যে। কেবল মার্কেসকেই বিশ্ববাসীর কাছে জনপ্রিয় বা নোবেল এনে দেয়নি উপন্যাসটি। এই উপন্যাস ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়েই পুনর্নির্মাণ ঘটেছে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের। জাদুবস্ততার শৈল্পিক জাল ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবী জুড়েই। যার খানিকটা আঁচ দক্ষিণ এশিয়ার ছোট একটা দেশে বসেও আমরা অনুভব করতে পারি।
নিজস্ব মিথ, জাদুবাস্তবতা আর লৌকিক পুরাণের যৌগিক মিশেলে তৈরি ‘নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর’ গল্পের পরিধি ছাড়িয়ে রূপান্তরিত হয়েছে মহাকাব্যে। কেবল মার্কেসকেই বিশ্ববাসীর কাছে জনপ্রিয় বা নোবেল এনে দেয়নি উপন্যাসটি। এই উপন্যাস ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়েই পুনর্নির্মাণ ঘটেছে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের
বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের দীর্ঘ কথকতা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই উপন্যাসের অবয়ব। যেখানে উপন্যাসের ফাঁক-ফোকর দিয়ে মার্কেস আমাদের ইতিহাসের অনিবার্যতার দীক্ষা দিয়েছেন। মার্কেস আমাদের বুঝিয়েছেন মানুষের একমাত্র গন্তব্য হচ্ছে নিঃসঙ্গতা।
মার্কেসের সমসাময়িক আরেক বিখ্যাত লাতিন লেখক কর্লোস ফুয়েন্তেস বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর প্রতিটি কোণে কল্পকাহিনি লেখকের দায়িত্ব থাকে বানানো কিছু চরিত্রের অবয়বের আড়ালে নিজের জীবদ্দশার সময়টাকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরা আর তার মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যে অংশগ্রহণ করা।’ মার্কেস হয়তো নিজের জীবনের গল্পই বলেছেন। মার্কেস বলেছিলেন, তিনি সারাজীবন আসলে একটি কাহিনিই লিখে গেছেন। আর তা হলো একাকিত্বের কাহিনি।
পাঠকমাত্রই নিঃসঙ্গতার ১০০ বছরের সম্মোহনী সেই শুরুর বাক্য মনে থাকবে—‘বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা, যেদিন তার বাবা তাকে বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিল।’
সম্প্রতি গ্লোবাল ওটিটি প্ল্যাটফরম নেটফ্লিক্স ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউডের যে ট্রিজার মুক্ত করেছে, সেখানেও দেখানো হয়েছে এই দৃশ্যকল্প।
ম্যাজিকাল দৃশ্যকল্পটি মার্কেসের শৈশবের সঙ্গে জড়িত। কেবল সেখানে মাকোন্দোর পরিবর্তে ছিল কলম্বিয়ার ক্যারিবীয় উপকূল তীরবর্তী শহর আরাকাটাকা। শৈশবে তিনি আরাকাটাকায় প্রথম বরফ দেখা ও বরফ স্পর্শের দৃশ্যকল্প মার্কেস তুলে এনেছিলেন ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড বা নিঃসঙ্গতার ১০০ বছরের শুরুতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে লেখক
মাকোন্দোর বুয়েন্দিয়া পরিবারের আখ্যানের আড়ালে মার্কেস মূলত নির্মাণ করেছেন কলোম্বিয়ার ইতিহাস। কলম্বিয়ার রূপক বিশ্লেষণ ছাড়াও বুয়েন্দিয়া পরিবারের কাহিনির মাধ্যমে বিভিন্ন জাতির পুরাণ কথাও এসেছে উপন্যাসে। ঔপনিবেশিক জীবনধারার উদারনৈতিক রাজনৈতিক সংস্কার এবং এর পক্ষে-বিপক্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীর যুক্তি, পর্বতময় ভৌগোলিক অবস্থানের দেশে রেলের আগমন, হাজার দিনের যুদ্ধ, ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির একীভূত আধিপত্য, সিনেমা, অটোমোবাইল, সরকারি শ্রমনীতির কারণে শ্রমিকদের ওপর চালানো সামরিক হত্যাযজ্ঞ—কলম্বিয়ার ইতিহাসের এ রকম অসংখ্য ঘটনা এসেছে ‘নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর’ উপন্যাসে।
বাংলা ভাষায় জি এইচ হাবিবের অনুবাদটি সর্বাধিক জনপ্রিয়। তবে তিনি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছিলেন। ২০১৭ সালে মূল স্প্যানিশ ভাষা থেকে বাংলায় এটি অনুবাদ করেছেন আনিসুজ্জামান। বাজারে তার অনুবাদটিও চলমান।
সাম্প্রতিক সময়ে নেটফ্লিক্সের ঘোষণার পর আবারও নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে ‘নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর’। তবে সেই আশির দশকে টাইম ম্যাগাজিনের এক সাহিত্যসমালোচক নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর নিয়ে মন্তব্য কলেছিলেন, ‘এটি এমন এক বই, যার সম্পর্কে সবাই কথা বলেন, তবে সবাই সেটি পড়েননি।’ মন্তব্যটি মিথ্যে নয় বটে।
২০১৯ সালেই জানা যায়, মার্কেসের উপন্যাসটি নিয়ে সিরিজ নির্মাণের সত্ত্ব নিয়েছে নেটফ্লিক্স। ২০২২ সালে মার্কেসের নোবেল বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তিতে একটি সংক্ষিপ্ত টিজার প্রকাশ করেছিল নেটফ্লিক্স। স্প্যানিশ ভাষার নির্মিত সিরিজের শুটিং হয়েছে কলম্বিয়ায়। কলম্বিয়ান এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি ডায়নামোর প্রযোজনায় সিরিজটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ১৬ পর্বের সিরিজটি লিখেছেন হোসে রিভেরা, নাটালিয়া সান্তা, ক্যামিলা ব্রুগেস, মারিয়া ক্যামিলা আরিয়াস ও আলবাত্রোস গনজালেজ। আর পরিচালনা করেছেন লরা মোরা ও অ্যালেক্স গার্সিয়া লোপেজ।
ওটিটির যুগে যখন কথা উঠছে নতুন প্রজন্মের পাঠাভ্যাস নিয়ে, তখন নেটফ্লিক্সের এই আয়োজন যেন অনেকটাই মেলকিয়াদেসের পার্চমেন্টের মতো। হোসে আর্কেদিও যেমন প্রত্যেকবার জিপসিরা এলে বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে নতুন তথ্য জানতে পারত, সেভাবেই এবার নেটফ্লিক্সের মাধ্যমে মার্কেসের সঙ্গে পরিচিত হবে জেনজি।