[রুশ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, রাজনৈতিক লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির জন্ম ১৮৬৮ সালের ২৯ মার্চ। পাঁচবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত এই সাহিত্যিকের মৃত্যু ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন। এই চিঠি লেখা হয়েছিল ৭ জানুয়ারি, ১৯০৬। তবে চিঠির শেষে তারিখ লেখা আছে ১ জানুয়ারি, ১৯০৬। চিঠিটি পাওয়া গেছে ম্যাক্সিম গোর্কি অন্তর্জাল মহাফেজখানা থেকে]
প্রিয় সঙ্গী,
দারিদ্র্যের ঘৃণ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম স্থূল অসংগতির জালে কেটে পৃথিবীকে মুক্ত করার সংগ্রামের সমার্থক, যে নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আপামর মানুষ প্রাণপণে অসম লড়াই করে চলেছেন।
তোমরা সাহসিকতার সঙ্গে এই জাল ছিন্ন করে বের হতে চাইছো, কিন্তু তোমাদের প্রতিপক্ষ আরো নিশ্চিদ্র বন্ধনে তোমাদের বাঁধতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই সংগ্রামে সততাই তোমাদের হাতিয়ার, অন্যদিকে শত্রুর হাতে আছে ত্রুর মিথ্যার অস্ত্র।
সোনার ঔজ্জ্বল্যে বিমোহিত হয়ে তারা এর শক্তিমত্তা সম্পর্কে এতটাই নিঃসংশয় যে, স্বাধীনচেতা শ্রমিক দল যে ক্রমশ শক্তিধর হয়ে উঠছে, তা তাদের অগোচর থাকে।
বাতুলের কাছে কাব্যচর্চা বা মূক ও বধিরের কাছে সংগীতের সুর যেমন অর্থহীন, তেমনই সমাজবাদ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাত্র শব্দগুলো এদের কাছে নিরর্থক। মুক্তিকামী মানুষের আলোকপ্রাপ্তির লক্ষ্যে বলিষ্ঠ কুচকাওয়াজ এদের শান্তি বিঘ্নিত করে। এই দিনদুনিয়ার মালিকানা হারানোর আতঙ্কে এরা নিজেদের জাতভাইদের কাছ থকে সত্যগোপন করে আর ন্যায়নীতিকে পরাস্ত করার অলীক কল্পনায় নিজেদের মনকে প্রবোধ দেয়।
সর্বহারাদের তারা একদল ক্ষুধার্ত পশুর সঙ্গে তুলনা করে এবং এই অপপ্রচার করে থাকে যে, এই সর্বহারা মানুষ এক টুকরো রুটির জন্য নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তির উপাদান ছাড়া আর সবকিছুর প্রতিই ধ্বংসাত্মক হতে পারে।
ধর্ম এবং বিজ্ঞান—এই দুই হাতিয়ারের সাহায্যে তারা তোমাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখে; জাতীয়তাবাদ আর ইহুদি বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে তারা নিখিল মানবের ভ্রাতৃত্ববন্ধন সম্পর্কে তোমার কাছে সম্পত্তির রক্ষক ছাড়া আর কিছু নয়া-রাশিয়ায় যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে, তারা অপপ্রচার চালায় যে, সর্বহারাদের প্রতিভূস্বরূপ শ্রমিক শ্রেণি সেখানে একটা অজ্ঞ, বন্য, ধ্বংসাত্মক শক্তি মাত্র, যার বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোনো গঠনমূলক ক্ষমতা নেই।
যে ব্যক্তি এখন জনগণের উদ্দেশ্যে এই চিঠি লিখছে, সে তোমাদেরই লোক, তোমরা তার পরিচিত, জনগণের সঙ্গে সে কখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেনি, রাশিয়ায় সর্বহারাদের এই বিপ্লবের একজন নিরপেক্ষ দর্শক হিসেবে সে তোমাদের উদ্দেশে ঘোষণা করছে, রাশিয়ার সর্বহারা মানুষ সচেতন সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে, অক্টোবর ত্রিশের ঘোষণাপত্র তারই ফলত। সম্রাটের স্বেচ্ছায় ঘোষিত ফরমান বলে প্রচারিত হলেও, এটা প্রকৃতপক্ষে জনগণের জয়স্বরূপ এক পুরস্কার। যদি জাতীয় স্বার্থ সরকারের কাছে প্রকৃতই অগ্রগণ্য বিষয় হতো, তবে এই সাম্রাজ্যের সর্বত্র অক্টোবর ত্রিশের ফরমান সমভাবে বলবত করার জন্য আইন প্রণয়ন করা হতো কিন্তু এ সরকার অবিন্যস্ত আইনি কাঠামোয় অভ্যস্ত, যাতে সমষ্টি অপেক্ষা ব্যষ্টির স্বার্থ সুরক্ষিত হয়।
সেজন্য সেন্ট পিটার্সবার্গের ঘোষণার অব্যবহিত পরেই প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা একত্রে জনগণের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল এটা দেখানো যে, রাশিয়ার জনসাধারণ এখনো রাজনৈতিক স্বাধীনতার যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে অক্ষম।
আমি আজ এই চিঠিতে যা লিখলাম, তা যে বর্ণে বর্ণে সত্যি—ইতিহাস তা প্রমাণ করবে
এই ষড়যন্ত্র, যার ফলে হিসেবে ইহুদিদের প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এবং সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চলেছিল, তার কথা পরে ষড়যন্ত্রকারীদের একজন মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেন।
তোমরা রাশিয়া প্রশাসনের সেসব জ্ঞানগর্ভ কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চয়ই অবহিত, যা শুধু অপরাধমূলক নয়, মানব ইতিহাসে যার জুড়ি মেলা ভার।
এ রকম পারিপার্শ্বিক অবস্থায়, বলাই বাহুল্য যে, ঘটমান সব সন্ত্রাসমূলক কাজের জন্য শুধু রাশিয়ার প্রশাসন বা তার শীর্ষে অবস্থানকারী দুর্বলচিত্ত, দ্বিধাগ্রস্ত সারজিয়াস উইটকে-ই দায়ী করা যায়। এহেন উইটকেই নাকি আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপের বুর্জোয়া গোষ্ঠী মহান রাষ্ট্রনায়ক আখ্যা দিয়েছে! এ রটনা যথার্থ হলে আমার সত্যিই আর কিছু বলার নেই। পশ্চিমের বুর্জোয়াদের মেধা ও মাননশীলতার গভীরতা সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে আমি অতি উচ্চধারণা পোষণ করি, তাই তারা একজন ব্যক্তি যিনি তার দেশকে উচ্ছন্নে পাঠিয়ে এখন আবার তা খুচরো বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন, তার মধ্যে একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রতিভা বা মেধার কী পরিচয় পেলেন—তা বুঝতে আমি অক্ষম। তুর্কি নীতির অঙ্গ হিসেবে রাশিয়ার রেলপথ বিদেশি পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, তাতে কোনো চরম মূর্খও তাকে বুদ্ধিমান বলবে না।
৩০ অক্টোবরের পর থেকে উইটের সরকার প্রকাশ্যেই রাশিয়ার এই গণ-অভ্যুত্থানকে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দিয়ে জনসাধারণকে এই বিরুদ্ধাচরণ করতে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। এ সরকার জাতীয়তার বিরুদ্ধে জাতীয়তা, শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রেণি, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শহর এবং গ্রামের বিরুদ্ধে গ্রামকে সংগ্রমে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করছে। আমরা এক যুগসন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে চলেছি, আর এ হলো সমসাময়িক ইতিহাসের এক নিরপেক্ষ মূল্যায়ন।
যেসব ঐতিহাসিকের দল বলেছে, দুর্ভাগ্যবশত বিপ্লবের লেলিহান শিখা জ্বলতে থাকা এ দেশের অশান্তি দমন করতে সরকার এসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তারা মিথ্যাচার করছেন। আমার এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সরকারের সব কার্যকলাপ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জনস্বার্থবিরোধী। আমার এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, সরকারের এসব কাজের উদ্দেশ্য হলো জনগণকে বিপ্লবের পথে নিতে বাধ্য করা আর তারপর সামরিক শক্তি দিয়ে সেই বিপ্লব ধ্বংস করা। সেন্ট পিটার্সবার্গে সম্মুখ সমরের প্রস্তুতি নেওয়ার আগে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এভাবেই সর্বহারাদের পর্যুদস্ত করে এই উচ্চবর্গের আঁততায়ীর দল। মস্কো এবং অন্যান্য শহরে বিপ্লবীদের নৈতিক জয় হয়েছে, কারণ এটা এখন গণতান্ত্রিক অধিকার হরণকারী সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণের সংগ্রাম।
রাশিয়ান সরকার তাদের কৌশলগত ব্যর্থতার কারণে বহুমূল্যের বিনিময়ে এই সংগ্রামে জয়ী হয়েছে ঠিকই কিন্তু এতে তাদের পাশবিকতা আর পৌরুষহীনতা নির্লজ্জভাবে উন্মোচিত হয়েছে। রাশিয়ার জনগণ এর ফলে আরো বেশি করে বামমুখী হয়ে পড়েছে এবং আগামী দিনে সর্বহারার দল নিশ্চিত জয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে, কারণ একমাত্র এরাই আত্মশক্তি ও বিশ্বাসের বলে বলীয়ান।
আমি ঘোষণা করছি, রাশিয়ান বিপ্লব হলো একটি গঠনমূলক সাংস্কৃতিক বিপ্লব, শুধু যার মাধ্যমে এ দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটা সম্ভব।
রাশিয়ার বুর্জোয়ার দল পুরুষত্বহীন এবং কোনো রকম গঠনমূলক রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণে অসমর্থ, তাই আমি পুনরায় ঘোষণা করছি, আমাদের দেশে উদ্ভূত অরাজক অবস্থার জন্য দায়ী সরকার পক্ষের আপন স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াস। দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই।
আমি আজ এই চিঠিতে যা লিখলাম, তা যে বর্ণে বর্ণে সত্যি—ইতিহাস তা প্রমাণ করবে, তবে যদি সেই ইতিহাসবিদ সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ হন।
সর্বহারার দল দীর্ঘজীবী হোক, কারণ তারাই এই পৃথিবীর পুনঃনবীকরণ ঘটাতে সক্ষম। পৃথিবীর সব শ্রমজীবী মানুষ দীর্ঘজীবী হন কারণ তাদের বলিষ্ঠ হাত দুটি দ্বারা এই পৃথিবীর সব সম্পদ নির্মিত হয়েছে এবং এখন তারা এতে প্রাণসঞ্চারে রত। সমাজবাদ দীর্ঘজীবী হোক, কারণ এটিই হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম।
সংগ্রামীদের অভিনন্দন, অভিনন্দন জানাই পৃথিবীর সব দেশের শ্রমিক শ্রেণিকে। সর্বদা তারা যেন সত্য ও ন্যায়ের অপরাজেয়তার প্রতি আস্থাশীল থাকেন। মানবতা দীর্ঘজীবী হোক, সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শে সমগ্র মানবজাতি সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক।