কবিতা

শব্দগুলো প্রিয় মানুষের মুখের

মাহবুবা ফারুক

কেন আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা
যেখানে বড় হয়েছি, যে জায়গার আলো বাতাস মেখে—সে জায়গাটা ছোটবেলা থেকেই খুব প্রিয়। ঠিক শহর না, আবার গ্রামও না। প্রকৃতি এবং মানুষের বিভিন্ন সৃষ্টির অপূর্ব এক সুন্দর জায়গা। সেখানে মানুষের কথা, মানুষের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করত। প্রকৃতি আমাকে মুগ্ধ করত। স্কুল ছুটির পর হেঁটে দূরে চলে যেতাম—কোনো গ্রামে ‘কাউয়া জাঙ্গীর গুডা’ আনতে, ঢেপ তুলতে। শাপলা তুলতে। কখনো হয়তো আমার সঙ্গে ছোট ছোট বন্ধু থাকতো কখনো একাই চলে যেতাম। কোথায় পাখির বাসা আছে, কোথায় কোন ফুল আছে, খুঁজে খুঁজে নতুন কিছু দেখতে যেতাম। গাছ এনে বাগান করতাম। নদীর ধারে যেতাম। নদী যখন শুকিয়ে যেত, নদী পার হতে চেষ্টা করতাম। নদীতে চর পড়লে পাতার বাঁশি বানানোর জন্য পাতা আনতে যেতাম। ঝিনুক কুড়াতাম। শামুক কুড়াতাম। ছুঁড়ে ছুঁড়ে আবার নদীতে ফেলে দিতাম। এটা একটা মজার খেলা ছিল। কাদা মেখে হাতে-পায়ে নদীর ধার ধরে হাঁটতাম। অনেক দিন সাপের ছোবল থেকে বেঁচে গেছি। মরতে মরতে অনেক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি। বাসায় কখনো সেগুলো বলতাম না। আম্মা আমাকে খুঁজে অস্থির হতেন। দুপুর গড়িয়ে যেতে যেতে বাসায় আসতাম নোংরা জামা নিয়ে। আম্মা রাগ করতেন। কিন্তু পরদিন আবার সেই একই কাজ করতাম।

এ ভাষাতেই আমার প্রিয়জনরা নিজের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করতেন। সে কথাগুলো বেঁচে থাক

আম্মা এবং নানাভাই আমাদের সব সময় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শেখাতেন। কিন্তু আমার ভালো লাগত আমাদের বাসায়, যারা সব সময় বিভিন্ন কাজে আসে বা থাকে। কাজ করে। আমাকে ভালোবেসে ডাকে। তাদের কথাগুলো শুনে মুখস্থ করতাম। ভালো লাগত ওদের কথা এবং কথা বলার ধরন। এত মায়া ভরে ডাকত ‘মাইয়া শইলডা ভালা? খাইছো?’ আমার কেন যেন বুকের ভেতরটা আনন্দে ভরে উঠত। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসতাম। তাদের কেউ কেউ আমাকে গল্প শোনাত। মাঠে-ঘাটে শোনা ছড়া শোনাতো। গান শোনাত। আমার ভালো লাগত। সেগুলো আমি আমার বন্ধুদের শোনাতাম। ওরা অনেক মজা পেত। কীভাবে যেন এ ভাষাগুলো আমার বুকের ভেতরে জায়গা করে নিয়েছে। বড় হতে হতে দেখি কিছু ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর অনেকেই সেই সব শব্দগুলো ব্যবহার করে না। হয়তো অনেকেই ভুলে গেছে কিছু শব্দ। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করে সেই সব ভাষাকে টেনে এনে বুকের কাছে জাগিয়ে রাখি। সেই চিন্তা থেকে মনে হলো—কিছু ভাষা আমি লিখে রাখি, যেগুলো আমার প্রিয়জনের মুখে শুনেছিলাম। যেগুলো আমার ছোটবেলার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অনেক দৃশ্য, অনেক শব্দ ভুলে গেছি, কিন্তু কিছু তো মনে আছে। সেগুলোকে ধরে রাখার জন্যে লিখে রাখতে চাই। কিছু লিখেছি, আরো লিখতে চাই। ভালোবাসা থেকে, মনের টান থেকেই লিখে রাখছি প্রিয় ভাষার কিছু শব্দ। যে শব্দগুলো অন্যের কাছে হয়তো অপরিচিত, হয়তো অতটা ভালো লাগবে না, কিন্তু আমার তো প্রাণের প্রিয় ভাষা। এ ভাষাতেই আমার প্রিয়জনরা নিজের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করতেন। সে কথাগুলো বেঁচে থাক। ভবিষ্যতে কেউ যদি কখনো পড়ে, হয়তো মনে পড়বে তার নিজের অতীত। হয়তো নতুন করে জানবে নতুন প্রজন্মের কেউ—এ শব্দগুলো ছিল কখনো প্রিয় মানুষের মুখে। কেউ ফেলে যাক। আমি কুড়িয়ে তুলব।

নেত্রকোনার বারহাট্টায় লেখক

নেত্রকোনার ভাষায় লেখা পাঁচটি কবিতা

আপনজন

সোমেশ্বরী আমার প্রিয়েশ্বরী
তোমার ডাক আমি কলিজাত ধরি।
যহন ঠার পাই ডাকতাছো আমারে,
ঝড় তুফানে কি আটকাইতো পারে?
আইতাছি বেকতা ফালাইয়া থইয়া,
দুক্কু জুড়াইবাম তুমার টাইন কইয়া।
ঢুপিখালী গাঙ তো আমার স্বগন,
পরানের বান্ধব পরানের আপন।
তুমরারে ছাড়া আমি কেউ না,
পুষকুনির ডেউ তো কিনু ডেউ না।

 

জাল

ছিপজাল বাইতাম আইয়া পাইত্তা দিছি মনের জাল,
ফিইরা যাওনের পথ আরাইয়া তুমার রূপে বেসামাল।
পানির উফরে যেমুন দেহি পানির তলেও তাই,
আসমান শুদ্দা দরা পরছে আমার উফায় নাই।
হাছা জাল ছেমার জাল মইদ্যিহানো আমি,
ছিনাইয়ের ভিত্রে মুক্তার লাহান অইছি আইজ দামি।

 

ডাক

তুমার কাছে জমা রইল
আমার শৈশব—পরান পক্কির ডেনা
জননীর কুলের ঘেরাণ,
গারো পাহাড়ের ডাক ফিরাই না আমি
কংস আমার কেওড়া জল,
তোমরার টানে বারেবারে আইবাম
আনন্দে সুহে থাইককো আমার জন্মমাডি
ভোলাইও দুক্কু তুমার স্তনের ওমে
তুমার নাম আমার চেতনানাশক
জগতের সব মোহ নিশা কাইড়া নিয়া
আমারে করে তুমার মধ্যে ধ্যানস্থ।

 

এঁওতার হাইনজায়

উনা ধানের গন্দে আমার মন যে ছুইট্টা যায়,
তহন তুমি গুনগুনাইয়া আঁচল উডাও গায়।
তুমারে কেমন গুইরা রাকছে পর্দার লাহান উষ,
তেও একবার দেখতাম চাই আমার বড় দুষ।
চুলার আগুন তুমার মুখ করতাছে পসর,
তুমার বাড়ির বারাত আমার যাত্রাগানের আসর।
নয়া ধানের চাউল দিয়া ভাত রানবা যেদিন,
চ্যাপা হিদল ভর্তা কইরো, ডাক দিও হেইদিন।
ছুডু মাছ দিয়া শাগের সালুন খুব ভালা লাগে,
ছিট রুডি, চিতই পিডা খাইতে ইচ্ছা জাগে।
আমারে তুমি জেফত দিও যুদি মনে চায়,
তুমার কতা মনো অয় বেইন্না আর হাইনজায়।
এঁওতার কাল ঘুইরা ফিইরা আইয়ে বারে বারে,
কত মানুষ দেহি আমি দেহিনা তুমারে।

 

অবহেলা

পরান খুইললা ডাহি তুমারে
হুনলা না
একবার দেখলা না কে রইলো খাড়ইয়া দুয়ারে
একজীবন ভাইসা গেল অবহেলার জোয়ারে।

 

লেখক পরিচিতি

মাহবুবা ফারুকের জন্ম নেত্রকোনায়। লেখাপড়া বারহাট্টা, ময়মনসিংহ ও ঢাকায়। বাবা-মার বড় সন্তান। পেশায় শিক্ষক। লেখেন স্কুলে পড়ার সময় থেকে। ভালোবাসেন প্রকৃতি এবং শিশুদের সঙ্গে মিশতে। ছড়া, কবিতা এবং গল্পের বই ১৪টি। রেডিও এবং টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকবি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার লেখা নাটক প্রচারিত হয়েছে। যোগাযোগ : mahbubafaruque@gmail.com

Leave a Comment

বিজ্ঞাপন

সম্পাদক : মীর হেলাল । শিল্প নির্দেশক : বদরুল হায়দার । © 2023 পৌষ
editor@poushh.com । তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা । 01914 441 825