শামীমার ঘ্রাণের অনুভূতি নেই। ভালো-মন্দ কোনো গন্ধই তার নাকে যায় না। সবাই যখন গন্ধে নাক সিঁটকায়, নাকে কাপড় চাপা দেয়—ও তখন অবাক হয়ে তাকায়। জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে? এখন অবশ্য সারা পাড়ার লোকই জানে—ও গন্ধ পায় না। তাই ও প্রশ্ন করলে অবাক হয় না। শামীমাও কথা শুনতে শুনতে বুঝে গেছে—নাকে হাতচাপা বা কাপড়চাপা দেওয়া মানে দুর্গন্ধ। আর বুক ভরে লম্বা শ্বাস নেওয়া মানে সুগন্ধ। এতেও অবশ্য সমাধান হয়নি। সব গন্ধ নাকে হাত বা কাপড়চাপা দেওয়ার মতো নয়, সব সুগন্ধ বুক ভরে নেওয়ার মতো নয়। অল্প গন্ধেই সমস্যা। সবাই পায় না। শামীমার পাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। তা নিয়ে নানা সমস্যা হয়, কথাও শুনতে হয় শামীমাকে অনেক।
এ নিয়ে শামীমার অনেক দুঃখ! যে দোষ তার নয়, সেজন্য কেন সে প্রতিদিন মানুষের কথা শুনবে! এটা কেমন বিচার!
প্রথমদিকে মাও বুঝতে পারেননি ও গন্ধ পায় না। আর ওর তো গন্ধের বোধই নেই। গন্ধ পায় কি পায় না—এ সম্পর্কে তার ধারণাই ছিল না। একটু একটু করে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা বুঝলেন, ওর গন্ধ নিয়ে সমস্যা আছে। প্রথমদিকে বোঝেননি সেটা, এতটা প্রকট যে, কোনো গন্ধই পায় না। আস্তে আস্তে বুঝেছেন।
যেটা আছে, সেটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। ভালোর প্রশংসা কেউ করে না। যা নেই, তা নিয়েই মানুষ কথা বলে
এক দিন দুধ পুড়ে বাড়ি গন্ধ হয়ে গেল। সবাই ছুটে গেল রান্নাঘরে। শামীমা অবাক হয়ে জানতে চাইল, কী হয়েছে? আর এক দিন পাশের বস্তিতে আগুন লাগল। ধোঁয়ার গন্ধে চারদিক সয়লাব। ভারি হয়ে গেল বাতাস। শামীমা বলল, কী হয়েছে, এত ধোঁয়া কেন? একবার বিদ্যুৎ ছিল না অনেক সময়। ফ্রিজের সব খাবার পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াল। ফ্রিজ খোলামাত্র ছড়িয়ে পড়ল দুর্গন্ধ। সবাই নাকচাপা দিল। শামীমা বলল, তোমরা অমন করছ কেন, নাকে কাপড়চাপা দিচ্ছো কেন?
: বুঝতে পারছিস না কেন, সব খাবার পঁচে গেছে। দুর্গন্ধ পাচ্ছিস না?
: না তো!
এভাবে আস্তে আস্তে বাবা-মা জানলেন—ও গন্ধ পায় না। তাদের মুখ ভার হলো। চিন্তার রেখা পড়ল কপালে। মা-বাবার কথোপকথন থেকে জানল কাজের লোক। আর তার থেকে জানল পুরো পাড়া, স্কুল-কলেজ। এখন ওকে দেখলেই সবাই ফিসফাস করে। পঁচা জিনিস ওকে সরাতে বলে। আর তো কেউ নেই ও ছাড়া। যেন ও ডোম, মেথর। এসব কাজতো ডোম মেথরেরও না। তাদেরও কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। শামীমার কোনো নির্দিষ্ট কাজ নেই, যেকোনো দুর্গন্ধ তাড়াবার দায় যেন তার, পঁচা মরা ফেলার দায় যেন তার। সে গন্ধ পায় না, এটা তার শাস্তি। অথচ অপরাধ তার নয়!
বাবা-মা ডাক্তার দেখালেন। বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। গোনা টাকার সংসারে বিস্তর টাকা খরচ হতে লাগল। অল্প বয়সেই ডাক্তার কবিরাজ ওষুধে বাধা পড়ল তার জীবন। কাজের কাজ কিছু হলো না। মা কাঁদেন, আক্ষেপ করেন, কপাল চাপড়ান।
: জানাজানি হয়ে গেছে। এ মেয়ের বিয়ে দেব কী করে? মেয়ে বলে কথা। জেনে-শুনে তো কেউ বিয়ে করবে না।
: কেন করবে না শুনি। এমনতো নয় যে, কানে শোনে না, চোখে দেখে না বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। ওর সবকিছু ঠিকঠাক। ভালো ছাত্রী, রেজাল্ট ভালো, দেখতে ভালো। কোনো অপরাধে বিয়ে হবে না শুনি? বাবা বলেন।
: গন্ধ না পাওয়ার অপরাধে। যেটা আছে, সেটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। ভালোর প্রশংসা কেউ করে না। যা নেই তা নিয়েই মানুষ কথা বলে।
: অত ভেব না। সমাজ বদলেছে। এখনকার ছেলেরা অনেক উদার, অনেক মানবিক। এই ছোট্ট কারণে কোনো সমস্যা হবে না দেখো।
: আমি তো সমাজের কোনো বদল দেখি না। যাক ভালো হলেই ভালো।

বনানীতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে লেখক
দুই.
শামীমার লেখাপড়া শেষ হয়েছে। ও একটা কলেজে চাকরি করছে। অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছে ওর। বিয়েগুলো হয়নি ওই একটা কারণে। মা গোপন করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। শামীমা রাজি হয়নি। এখন আর ও বিয়ের কথা ভাবে না। বাবা-মা হতাশ!
সেদিন শামীমা কলেজ থেকে ফেরার পর উৎফুল্ল কণ্ঠে মা বললেন,
: তোর খুব ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। অনেক দিন পর প্রস্তাবটা এলো। ওরা তোর বিষয়টা জানে। তারপরও রাজি।
শামীমা অবাক হয়ে বলল,
: সব জানার পরও রাজি! কেন?
: কেন কিরে, তোর কিসে কমতি আছে বল?
: মা এসব বাদ দেওয়া যায় না?
: তুই অমত করিস না। আমাদের বয়স হয়েছে।
: ঠিক আছে, আমি ছেলের সঙ্গে কথা বলব।
: তা বল, তবে নেগেটিভ কিছু বলিস না। আমি চাই বিয়েটা হোক।
ছেলের সঙ্গে কথা বলল শামীমা। ছেলে বলল, সে সব জানে। শামীমা তাকে বলল নানা সমস্যার কথা। খাবার পুড়লে গন্ধ পাবে না, আগুন লাগলে গন্ধ পাবে না, এমনকি পায়খানা-প্রশ্রাবের গন্ধও সে পাবে না। এগুলো তো সমস্যা। লজ্জা ভেঙে সে বলল,
: ধরুন আমাদের কোনো সন্তান হলো। সে ময়লা মেখে পড়ে থাকলেও আমি গন্ধ পাব না।
: এটা কোনো সমস্যা না। আজকাল বাচ্চাদের ডাইপার পরানো হয়।
: কী বলছেন, সময়মতো পরিষ্কার না করলে অসুখ-বিসুখ হয়!
: বেশ তো, আপনি বারবার দেখবেন। আপনি নাকে গন্ধ পান না। কিন্তু চোখে তো দেখেন। কেমন পটলচেঁরা চোখ আপনার!
সবচেয়ে কমন উপমাটা দিল ছেলেটি। শামীমার খারাপ লাগল না। যা মনে এসেছে বলেছে। বলার জন্য সময় নেয়নি, তো তো করেনি। অন্যের কাছ থেকে কুড়িয়ে বলেনি।
আপনি নাকে গন্ধ পান না। কিন্তু চোখে তো দেখেন। কেমন পটলচেঁরা চোখ আপনার!
তিন.
বিয়ের পর সত্যিই ওদের সন্তান হলো। আর নানারকম সমস্যা হলো। খাবার পোড়ে। ঘামে জামা ভিজে গন্ধ হয়। খাবার পঁচে যায়। সন্তান ময়লা মাখিয়ে পড়ে থাকে। কোনো গন্ধই যায় না শামীমার নাকে। প্রথমদিকে একটু পর পর চেক করলেও এখন ওর ইচ্ছে করে না। এ নিয়ে সংসারে অশান্তি! স্বামী যতটা বলে, শ^শুর-শাশুড়ি বলেন তার দশগুণ। শাশুড়ি কথায় কথায় এটাও বলে, এ বিয়েতে তার মোটেও সায় ছিল না। ছেলের চাপে বিয়ে দিয়েছে। শামীমার খারাপ লাগে। সে কী করবে! এখন ও খাবার পরিবেশন করার আগে নিজে খায়। তারপর যদি মনে হয় খাবার ঠিক আছে, তাহলে স্বামী শাশুড়ির পাতে দেয়। সে কোনো ঝুঁকি নেয় না। শাশুড়ি সেদিন বললেন,
: প্রতিটা খাবার তুমি আগে খাও। এতে খাবার এঁটো হয়ে যায়। তা ছাড়া বউ মানুষরা কী কখনো আগে খায়! আমরা তো সারাজীবন সারা বাড়ির লোক খাবার পর খেয়েছি।
: কিন্তু মা, আমি না খেলে যে বুঝি না—খাবার ঠিক আছে কি না!
শাশুড়ি তপ্ত চোখে তাকালেন।
আরেক দিন খেতে খেতে শাশুড়ি বললেন,
: কী ব্যাপার বউমা, গরুর মাংসটা দিলে না যে?
: ওটা একটু নষ্ট হয়েছে মা। খেয়ে দেখেছি।
শাশুড়ি উঠলেন। মাংস খেয়ে দেখলেন। তারপর বাড়ি মাথায় করলেন। কোথায় নষ্ট হয়েছে। একদম ঠিক আছে। আজকাল মাঝে মাঝেই দেখি অনেক খাবার তুমি দাও না। এটা কেমন কথা। বাড়ির মুরব্বিদের, স্বামীকে তুমি খাবার দাও না!
: মা গরম পড়েছে। খাবার নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট খাবার দিলে আপনি রাগ করেন, তাই দিই না।
: তুমি নষ্ট বোঝো কী করে। তুমি তো গন্ধই পাও না। গন্ধের মতো তোমার স্বাদের অনুভূতিও কী নষ্ট হয়ে গেছে! হায়রে আল্লাহ, আমার একটা মাত্র সন্তান এ কী বিয়ে করল!
: মা আমি বিয়ের আগেই আপনার ছেলেকে বলেছিলাম সমস্যা হবে। সে মানেনি।
এবার স্বামীও রেগে ওঠে,
: ওই এককথা বারবার বলবে না। তখন কে জানত তোমার এতটা সমস্যা। এত প্রকট সমস্যা জানলে বিয়ে করতাম না।
চার.
সেদিন সারারাত ফুলে ফুলে কাঁদল শামীমা। স্বামী একটিবার তার কাছে এলো না। সান্ত্বনার হাত রাখল না তার পিঠে।
পরদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় শামীমা টমি নামের একটা কুকুর নিয়ে এলো। কুকুর দেখে তেড়ে এলো শাশুড়ি- শ^শুর। স্বামী অফিস থেকে ফিরে চরম বিরক্ত হলো! সবার বাক্যবাণের মধ্যে শামীমা বলল,
: আমি গন্ধ পাই না, ও গন্ধ পায়। এবার থেকে ওই আমাকে বলবে কোনটায় গন্ধ আছে, কোনটায় নেই।
: তার মানে কী, কুকুর খাবার শুকে শুকে দেখবে আর সেই খাবার আমরা খাব! অসম্ভব। যাও, কুকুর বের করে দাও।
: আপনারা যেমনটা ভাবছেন তেমন না। ও খাবারের কাছে যাবে না। দূর থেকেই গন্ধ পাবে। তা ছাড়া শুধু খাবারের গন্ধ না। সবরকম গন্ধই পাবে। ট্রেনড কুকুর। একটু সুযোগ দিয়ে দেখুন প্লিজ।
টমি আসার পর শামীমার জীবন অনেকটা সহজ হয়ে গেল। কোনো গন্ধ পেলেই ওর নাক কুঁচকে ওঠে। নাক ফুলতে থাকে। যেদিক থেকে গন্ধ আসছে, সেদিকে শামীমার আঁচল ধরে টেনে নিয়ে যায়। বাচ্চা কাপড় নষ্ট করা মাত্র সে শামীমাকে বাচ্চার কাছে নিয়ে যায়। শামীমা এখন অনেকটাই ওর ওপরে নির্ভরশীল। বাড়িতে বকাঝকাও আগের চেয়ে কমেছে। ভালোই আছে শামীমা। মাঝে মাঝে নিজের বুদ্ধিকে প্রশংসা করে। ভাগ্যিস কুকুর আনার আইডিয়াটা তার মাথায় এসেছিল!
ছেলের বয়স পাঁচ বছর। শামীমা আর স্বামী আসিফের সম্পর্ক এখন অনেকটা অভ্যাসের। ও আগের মতো শামীমাকে নিয়ে বেড়াতে যায় না, সিনেমা দেখে না, রেস্টুরেন্টে খায় না। ওর অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়। কলেজের সহকর্মীরা বলে এটাই নাকি স্বাভাবিক। শামীমার মন কেমন করে, তবে মেনে নেয়।
আসিফ বলেছে, যার এমন সুগন্ধি বউ আছে তার সেন্ট লাগে না!
সেদিন অফিস থেকে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরল আসিফ। শামীমা ওর খাবার আগলে বসে রইল। বাসায় এসে আসিফ ঘরে ঢুকে কোনোক্রমে কাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়ল। শামীমা খেতে ডাকলে হাই তুলতে তুলতে বলল, খেয়ে এসেছে। এমন ঘটতে লাগল প্রায়ই। এর দিনকয়েক পর আসিফ কলেজ থেকে ফিরলে টমি মুখে করে নিয়ে এলো আসিফের শার্ট। শামীমার আঁচল ধরে টানতে লাগল। শামীমা শার্টটা হাতে নিল। উল্টে পাল্টে দেখল। কিছুই বুঝল না। টমিকে মৃদু ধমক দিল। ভাবল শার্টটা হয়ত ঘামে ভেজা। সে কাপড় কাচার বালতিতে ফেলে দিল। পরদিন আসিফ ফেরার পর একই কাজ করল টমি। শামীমা আজও শার্টটা বালতিতে ফেলল। এভাবে পরপর তিন দিন। পরদিন শুক্রবার। শামীমা কাজের বুয়াকে শার্টগুলো ধুতে দিল। বুয়া শার্টটা হাতে নিয়ে লম্বা করে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল,
: ভাইজান কী সুগন্ধি সেন্ট মাখে! বাপরে কী দারুণ! এরপর একে একে সে বাকি দুটো শার্টও নাকের কাছে ধরল।
তারপর শামীমার দিকে তাকিয়ে বলল,
: তুমি কিনে দিয়েছ ভাবি? তোমার পছন্দ ভালো। কিন্তু তুমি তো…।
শামীমা অবাক! আসিফ-শামীমা কেউই সেন্ট ব্যবহার করে না। শামীমা দু-একবার তাকে সেন্ট মাখার কথা বলেছে, কিনেও দিতে চেয়েছে। আসিফ বলেছে—
: যার এমন সুগন্ধি বউ আছে তার সেন্ট লাগে না!
শামীমার একবার ইচ্ছে হয়, শার্টগুলো তুলে খুঁটিয়ে দেখতে—কিছু দেখতে পায় কি না। কিন্তু দেখে না। আর কিছু দেখার দরকার নেই। ও টমিকে জড়িয়ে ধরে।