‘মানব-মানবীর সম্পর্ক, নারী-পুরুষ তথা মা-মেয়ে, মা-বাবা, বাবা-ছেলে প্রভৃতি সম্পর্কের বিশ্লেষণ এবং অভিজ্ঞতা বিচিত্র প্রভাব রেখেছে আমার লেখাজোকায়, আর এসব সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন নতুন গল্প লিখেছি আমি।’
নিজের লেখালেখি নিয়ে বলছিলেন সেলিনা হোসেন। এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি। পৃথিবীর আদিম সাহিত্যেও এ সম্পর্কের বিস্তার দেখা যায়। অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে তথা প্রয়োজন সাপেক্ষ আর্ট (এ ক্ষেত্রে এক প্রকার কৌশলই বলা যাবে তা) সৃষ্টির সময়টা বাদ দিলে, মোটামুটি দলগতভাবে বসবাসের সময় মানুষের মনোবৃত্তিক শিল্পের উৎস হিসেবে মানবিক এই সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। এটা মানুষের অস্তিত্ব অনুভবের প্রাথমিক উপায়ও। তবে সাহিত্যের আধুনিক যাত্রার সূচনায় মানুষের এই সামাজিক, মানবিক সম্পর্ককে উৎস হিসেবে বিচার করা যেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাবৎ পৃথিবীতে রচিত সাহিত্যের বিষয়বস্তু হিসেবে এটাই সর্বাধিক ব্যবহৃত একটি দিক এবং এও বলা যায়, ‘ব্ল্যাক হোল’-এর মতো এটি সবচেয়ে রহস্যময় একটি জায়গা। প্রত্যেক লেখকই এই অন্ধকারে আলো ফেলে নিত্যনতুন আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। লেখিকা সেলিনা হোসেন যখন তার নতুন গল্পের উৎস হিসেবে এই মানবিক আঁধারকে বেছে নেন, বলা যায়, তিনি উৎসকেই বেছে নিয়েছেন। তার লেখালেখির সাহিত্যে প্রয়াস মানুষ ও প্রকৃতির সহ-অবস্থান দেখা যায়।
জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যে সংকটে পতিত হলো, তা হচ্ছে তার সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব। পৃথিবীতে যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা থেকেই মানুষ ঔপনিবেশিকতার মুখোমুখি হয় নতুন ও প্রবলভাবে। তাই অবশ্যম্ভাবীভাবেই সাহিত্যে ইতিহাসের সন্নিবেশ ঘটে। সেলিনা হোসেন যে আলো ফেলে এই সম্পর্ক দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন, তা হলো সময় তথা ইতিহাস। এ কারণে ইতিহাস তার সাহিত্যে নানাভাবে এসেছে। রাষ্ট্র বিভাজনের সূচনায় বাঙালি জাতির স্বাতন্ত্রিক রাষ্ট্রের উৎসের যে ইতিহাস, সেই ৪৭, ৫২, ৭১ ঘুরে-ফিরে এসেছে তার সাহিত্যে। এদিক বিবেচনা করলেও সেলিনা হোসেনের সাহিত্য উৎস থেকেই উৎসারিত।
গত ১৪ জুন, তিনি ৭০ বছরে পা দিলেন। এই অতিক্রান্ত উনসত্তর বছরের মধ্যে ৫২ বছর যাবৎই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন। তার লেখার সংখ্যা অনেক। বিষয় বৈচিত্র্যেও তা অনন্য। মূলত, বাংলা সাহিত্যে এখন অবধি যে কজন লেখক বিপুল সমৃদ্ধিতে টিকে আছেন, তার মধ্যে সেলিনা হোসেন অত্যন্ত সম্মানীয়দের একজন। লেখিকার ভাষায়, ‘আমার এক হাতে লেখালেখি আরেক হাতে আমার সমস্ত জীবন।’
এ কথা অস্বীকার করা যায় না, হাজার হাজার বছরের লেখালেখির ইতিহাসে নারী লেখকের আগমন খুব বেশি দিনের নয়, তা ছাড়া বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে শুধু নারী লেখক হিসেবেই। সে কারণে তাদের সংখ্যাও অত্যন্ত কম। এমনকি আধুনিক সমাজে তাদের উপেক্ষার মাত্রাও এতটাই বেশি যে, দেশে ‘লেখিকা সংঘ’ বলে একটি পরিষদও দেখা যায়। কিন্তু সেখানে ‘নারী’ হয়েও তিনি ‘লেখক’, এ হিসেবে যেমন মূল্যায়ন চাওয়া হয়, তেমনি আবার অনেক সময় করুণা বা সুবিধা প্রার্থনাও করা হয়। কারণ, তাদের অনেকের লেখাই আবার ‘নারীবাদী’ ফেনমেনা দ্বারা আক্রান্ত। তবে, সেলিনা হোসেনকে আমরা কোনোভাবেই এই কাতারে ফেলতে পারি না। পারি না তার লেখনীর কারণে। তিনি অনেক আগেই তার লেখনীর বিষয় বস্তু, বিপুল সৃষ্টি ও শক্তি দিয়েই জানান দিয়েছেন, ‘লেখক’ মানে শুধুই লেখক, তার কোনো লিঙ্গ হয় না। বরং লেখক তার উচ্চমানবিকতার জন্যই সাহিত্যে পিছিয়ে পড়া মানুষকে তুলে আনেন। যে কারণে আমরা সেলিনা হোসেনের সাহিত্যে নানাভাবেই নারী চরিত্রের উপস্থিতি দেখি। তবে তারা সংগ্রামী ও আত্ম-প্রত্যয়ী। সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতার মতো গুরুতর কাজ সে প্রজ্ঞার সঙ্গেই করে।
সেলিনা হোসেন লেখনীর মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে তার স্থান পাকাপাকি করে নিয়েছেন। তিনি একজন কথাসাহিত্যিক। সংগ্রামী আলেখ্য তার উপন্যাসের মৌলিক উপাদান। তার সৃষ্ট অধিকাংশ চরিত্রই সংগ্রামী ও সংবেদনশীল। ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও আন্দোলন তার ঔপন্যাসিক সত্তাকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছে। তার উপন্যাসে রয়েছে একদিকে শ্রেণি সংগ্রামের উদ্দীপনা, অন্যদিকে শোষণ মুক্তসমাজের স্বপ্ন। যদিও আজকের দিনে লেখালেখি নিয়ে ভিন্নকথা বলার সুযোগ আছে বৈকি।
এসবের একটা সূত্র সেলিনা হোসেনের জন্ম ও লেখক হিসেবে বেড়ে ওঠার মধ্যেই পাওয়া যাবে। সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন। তার পৈতৃক নিবাস বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরের হাজিরপাড়া গ্রামে। তার জন্ম সময়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন উতুঙ্গপর্যায়ে। তার জন্মের দুই বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসের ৬ ও ৯ তারিখে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে প্রথম আণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। যার অপঘাতে সেখানে তাৎক্ষণিকভাবেই আড়াই লক্ষাধিক মানুষ নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়। যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে অনেক দেশেই তখন হতাহতের ঘটনা ঘটে। ভারতবর্ষ পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতার সরাসরি শিকার না হলেও পতিত হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে। ১৯৪৩ কিংবা ইতিহাসে বঙ্গাব্দ ১৩৫০ অনুসারে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ ঘটে, লেখিকা জন্মের চার বছর আগে। তাতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে তাৎক্ষণিক নিহতের তুলনায় ২০ গুণ বেশি মানুষ মারা যায় না খেয়ে। এই রেশ সেলিনা হোসেন জন্মমাত্রই লাভ করেন। সবচেয়ে বড় যেদিক, তার জন্মের তিন মাসের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়। আবার ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনা ঘটে তার জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যেই। আরো একটি দিক হলো, তার জন্মস্থান রাজশাহী তখন তেভাগা আন্দোলনের জন্য ছিল উত্তাল। একজন ভবিষ্যৎ সংবেদনশীল লেখক হিসেবে সেলিনা হোসেন এসব ঘটনার আঁচ গায়ে মেখে বেড়ে উঠবেন, তা খুবই স্বাভাবিক।
সেলিনা হোসেনের লেখালেখি শুরু সেই স্কুলবেলাতেই। গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি, তিনি যখন রাজশাহী উইমেন্স কলেজের ছাত্রী তখন বিভাগীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নশিপ স্বর্ণপদক পান। পরে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬৭ সালে বিএ (অনার্স) ও ৬৮ সালে এমএ সম্পন্ন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তিনি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চর্চায় নিবিড়ভাবে যুক্ত হন। সে সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি সমাজ দর্শন হিসেবে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত, ১৯৬৭ সালে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পাঞ্জাব যাওয়ার কথা থাকলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে যাওয়া হয়নি। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার মতো, সে সময় এই রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা অনেকে অনুপ্রাণিত হলেও পরে তাদের অনেকের বোল-চাল আমূল বদলে যায়, মৌখিক স্বীকারটুকু ব্যতিরেকেই। এমনকি কেউ কেউ প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানও গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি তা পরিহার করেননি। বরং ক্রমাগত পড়াশোনা, জীবন দেখা ও বোঝার দিকে ছিল অগ্রযাত্রা। বারবার সত্যতা যাচাই করেছেন, আর লেখনীর মাধ্যমে তার বিস্তার ঘটিয়েছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ৫২, ৫৪, ৬২, ৬৫ এবং ৬৯ সময় পর্ব তিনি খানিক বোঝাপড়ার মধ্যেই অতিক্রম করেছেন এবং শিক্ষাজীবনে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। আবার, ৬৯ সালেই পাকিস্তানিদের হাতে খুন হওয়া বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক ছিলেন। সুতরাং এসব কালপর্ব ও ঐতিহাসিক ঘটনা মনে রাখলে বলা যায়, সেলিনা হোসেনের কোনো সুযোগই ছিল না, ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হওয়ার। বরং এও বলা যায়, সেলিনা হোসেন তার প্রজ্ঞা ও মননের মাধ্যমে তার সময় ও ইতিহাসের প্রতি যথার্থই সাড়া দিয়েছেন। প্রথম জীবনে তিনি কবিতা দিয়েই সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন। ষাট দশকের মাঝামাঝি এসে গল্প লেখা শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তার গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। অর্থাৎ স্বাধীনতা-পূর্ব এক সান্ধ্য ও নিয়ন্ত্রিত সময়ে একজন ‘নারী’ সাহিত্য মাধ্যমে সক্রিয় থেকেছেন, গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন—এটা সত্যিই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সে বছর প্রবন্ধের জন্য তিনি ডক্টর এনামুল হক স্বর্ণপদ পান।
তার প্রথম গল্পগ্রন্থের নামের ভেতর যে দ্যোতনা ছিল, তা পরবর্তী সময়ের লেখা দিয়ে বহুদূর তাড়িয়ে এনেছেন। তিনি এখনো বাঙালির যে উৎস তা নানাভাবে উন্মোচন করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি বিপুল ও সমৃদ্ধ লেখনী দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে পুষ্ট করছেন। এরই মধ্যে তার ৩১টি উপন্যাস, ১১টি গল্পগ্রন্থ এবং ৯টি প্রবন্ধের গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। এ ছাড়া তার ৩০টি শিশুতোষ গ্রন্থ আছে। তিনি নারী অধিকারবিষয়ক বেশ কিছু প্রামাণিক ও গবেষণা গ্রন্থও রচনা এবং সম্পাদনা করেছেন, যা তার সমাজ-মনস্কতা ও বৈচিত্র্যকেই নির্দেশ করে।
লেখালেখির দর্শনের ব্যাপারে তিনি বরাবরই স্বচ্ছ। ‘তখন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম। ভেবেছিলাম এই রাজনীতি মানুষকে ভাত, আশ্র্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সুব্যবস্থা দেবে। মানুষের জীবন হবে স্বস্তি ও শান্তির। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষে রাজনীতির পাঠ শেষ করে দিই, শুধু লেখালেখির জগৎ ধরে রাখব বলে। রাজনীতির যে আদর্শগত দিক শিক্ষাজীবনে গ্রহণ করেছিলাম তার প্রয়োগ ঘটিয়েছি লেখায়। তবে সরাসরি নয়। সৃষ্টি কাহিনি, চরিত্র, ঘটনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। মানবিক মূল্যবোধের জায়গা সমুন্নত রেখে। বেঁচে থাকার মাত্রার সমতার বিন্যাস ঘটিয়ে। মানুষের ভালোমন্দের বোধকে রাষ্ট্র সম্পর্কের জায়গায় রেখে আমি রাজনীতির নানা দিকের প্রতিফলন ঘটাতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা জনসাধারণের জীবন রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে মানুষ এটাই আমার গভীর বিশ্বাস।’ অপর এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’। উপন্যাসটিতে তার শৈশবের প্রকৃতি, বঙ্গোপসাগর এবং অসংখ্য নদী-নালা দেখে চিত্রকল্প খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন। এখানে বাবার চাকরির সুবাদে তার শৈশবের বেড়ে ওঠা বগুড়া শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী ও জলার দৃশ্যের ছায়া দেখা যায়।
তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্র্রতিবাদ করে। স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশে ফিরে এসেছে স্বৈরশাসন। কিন্তু তিনি কখনোই স্বৈরশাসন মেনে নিতে পারেননি। বরং তার প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে তার লেখা ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাস, যেখানে সামরিক শাসনের নানা প্রসঙ্গ এসেছে।
সাম্প্রতিক সময় ছিটমহল প্রসঙ্গটি নানাভাবেই আমাদের দেশে আলোচিত। লেখিকা নিজে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা এবং পঞ্চগড় এলাকার অনেকগুলো ছিটমহল ঘুরে দেখেছেন তার ভ্রমণের নেশা থেকে। সেখানে জীবনের সংকট ও নিয়ন্ত্রিত জীবনের অভিজ্ঞতার নিরিখে লেখেন ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাসটি।
সেলিনা হোসেন জীবনে বিরূপ অভিজ্ঞতাকেও নান্দনিকভাবে উপন্যাসে রূপান্তর করেছেন। এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তার প্রিয় মেয়ে বৈমানিক ফারিহা লারা। তার স্মৃতি ও লেখকি যন্ত্রণা থেকে লেখেন ‘লারা’ উপন্যাসটি। এটি তার ব্যক্তিগত স্মৃতিজাত হলেও তাতে মা-মেয়ের সম্পর্কের চিরন্তন জায়গাটিই মুখ্য করে তুলেছেন।
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ সেলিনা হোসেনের একমাত্র ট্রিওলজি (উপন্যাস ত্রয়ী)। ১৯৯৪ সাল থেকে যথাক্রমে এর খণ্ডগুলো প্রকাশ হয়। এতে তিনি ৪৭ থেকে ৭৫ কালপর্বের সবগুলো রাজনৈতিক ঘটনার অভিঘাত চিত্রিত করতে চেয়েছেন। উপন্যাসটির জন্য তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ পেয়েছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত তার গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘যাপিত জীবন।’ ১৯৮১ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি পরে তিনি পরিবর্ধন করে বৃহৎ কলেবর দিয়েছেন। এটি এখন পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্র্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিভুক্ত। এ ছাড়া শিলচরের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ৫টি উপন্যাস এমফিল গবেষণাভুক্ত হয়েছে। তবে তার সবচেয়ে আলোচিত ও বিখ্যাত উপন্যাস বলা যায় ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। ১৯৭৬ সালে এটি প্রকাশের পরই বোদ্ধাজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি প্রাতঃস্মরণীয়। উপন্যাসটি নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ৭৫-এর পটপরিবর্তন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ও তার নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণে তা আর করা হয়নি। যদিও আশির দশকে বাংলাদেশে এর চলচ্চিত্রায়ণ হয়। সে সময় সত্যজিৎ রায় এক চিঠিতে তাকে লেখেন, ‘ট্যারোড্যাকটিল’ পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার ছোট গল্পটি পড়ে আমার যে খুব ভালো লেগেছিল তা আমি অনেককেই বলেছিলাম। গল্পটি থেকে ভালো চলচ্চিত্র হয় এ বিশ্বাসও আমার ছিল। কিন্তু তখন আমার হাতে অন্য ছবি থাকায় ওটার কথা চিন্তা করতে পারিনি। পরে বাংলাদেশে গিয়ে ছবি করার প্রশ্নে ওঠে আরেকবার; তখন শুনেছিলাম ওখানকার অবস্থা ভালো নয়, নানা রকম অন্তরায়ের সম্ভাবনা আছে। সুতরাং, পরিকল্পনাটি স্থগিত থাকে।’
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি তাকে আন্তর্জাতিক পরিচিতিও এনে দিয়েছে। ১৯৮৭ সালে এটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ হয়। প্যারিসের দ্য গল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক পাস্কেল জিন্ক (Pascal Zink) নেট থেকে বইটির ইংরেজি সংস্করণ সংগ্রহ করেন। সাউথ এশিয়ান লিটারেচারের এ অধ্যাপক বইটির আধুনিক অনুবাদেরও উদ্যোগ নেন, যা ভারতের রূপা প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া শিকাগোর ওকটন কমিউনিটি কলেজে এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ চারটি সেমিস্টারে পড়ান হয়। ২০০১ সালে উপন্যাসটি ভারতের কেরালা থেকে মালয়ালাম ভাষায় অনূদিত হয়।
বরাবরই লেখালেখির পেশাকে সেলিনা হোসেন গ্রহণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনোর পর তিনি বিভিন্ন পত্রিকার উপসম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে তার প্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের জন্ম দিনে (১৪ জুন) তিনি এ পদ থেকে অবসর নেন। ৩৪ বছরের কর্মসময়ে তিনি বাংলা একাডেমির অভিধান ও বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলি প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করেন। উল্লেখ্য, এ ছাড়া ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন।
তবে বাংলা একাডেমিতে গবেষণা সুবাদে ইতিহাসের বহু মানুষ সম্পর্কে তার জানার সুযোগ হয়, যা তার সাহিত্যকে জীবনীভিত্তিক কাজে প্রবাহিত করে। তিনি বিভিন্ন সময় ঐতিহাসিক বিষয় ও চরিত্রের সমকালীন প্যারালালধর্মী উপন্যাস লিখেছেন, যা লেখিকার ভাষায় ‘ঐতিহ্যের নবায়ন’। তিনি মোগল আমলের বিখ্যাত কবি মির্জা গালিবের জীবনী নিয়ে লেখেন ‘যমুনা নদীর মুশায়েরা’। এতে গালিবের জীবনের এক ধরনের ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। অগ্নিযুগের বিপ্লবী প্রীতিলতাকে নিয়ে লেখেন ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’।
‘নীল ময়ূরের যৌবন’ তার ইতিহাসভিত্তিক সাহিত্য। ১৯৮৩ সালে উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ হয়। ২০০০ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হয় তার ‘টানাপড়েন’ উপন্যাসটি। ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসে দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের মানুষের জীবনের খুবই বাস্তব এবং জটিল একটি অধ্যায় তুলে ধরেছেন সেলিনা হোসেন। শোষিত শ্রেণির উত্থানে শাসক শ্রেণির মধ্যে যে হিংসা, আতঙ্ক দেখা দেয় এবং এ থেকে উদ্ভূত ক্রোধ তাদের নিকৃষ্ট কাজ করতেও বাধা দেয় না—সে ব্যাপারটা তিনি কৃতিত্বের সঙ্গেই দেখিয়েছেন।
১৯৪৭-এ দেশভাগ, রাজনৈতিক বিভাজন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সঙ্গে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের (যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত) ভয়াবহতায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিছু পরিবারের চিত্র নিয়ে লেখেন ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’। উপন্যাসটি ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিভুক্ত।
সাহিত্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে সেলিনা হোসেনের অন্যতম জায়গা বলা যায় রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্র্রনাথ নিয়ে তার পঠন-পাঠন কত গভীর তা তার ‘পূর্ণছবির মগ্নতা’ উপন্যাসে পাওয়া যায়। উপন্যাসটিতে তিনি রবীন্দ্র্রনাথকে অনেকটা এ দেশীয় নির্মাণ দিয়েছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি আখ্যানের ভেতরে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের রতন, ‘শাস্তি’র চন্দনা, ‘ছুটি’ গল্পের ফটিককে পুনর্র্নির্মাণ করেছেন। এ বিষয়ে লেখিকার বক্তব্যও তাৎপর্যপূর্ণ। ‘আমার সব সময়ই মনে হয়, রবীন্দ্র্রনাথ এ ভূখণ্ডে না এলে, যাদের আমরা সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ বলিÑ কবির অদেখায় থেকে যেত এই জনগোষ্ঠী। তাতে হয়তো তার জীবনদর্শনও অপূর্ণ থাকত খানিকটা। আমার পূর্ণ বিশ্বাস, আমাদের এই বাংলাই ভিন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে রবিঠাকুরকে।’
গল্পের ক্ষেত্রেও তিনি সাফল্য ও প্রাচুর্য দেখিয়েছেন সমানভাবে। ১৯৭৫ সালে প্রকাশ হয় তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘জলবতী মেঘের বাতাস’। নানা কারণেই এটি বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সবগুলোই পত্রগল্প। এতে তিনি সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, হাসান আজিজুল হক, বদরুদ্দীন উমর, আবদুল গাফফার চৌধুরী, কবীর চৌধুরীসহ দশজনকে সম্বোধন করে পত্র ভাষায় গল্প লেখেন।
সাহিত্যে সমাজনিষ্ঠতা থেকেই সেলিনা হোসেন নারীর ক্ষমতায়নে সচেষ্ট। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের প্রাথমিক ধাপ বলে মনে করেন। এজন্য ‘লারা ফাউন্ডেশন’ নামক একটি সামাজিক উন্নয়ন সংগঠনও গড়ে তুলেছেন তিনি। ২০১৪ সালে দুই বছরের জন্য তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সেলিনা হোসেনের সাহিত্যের পরিচিতি অনেক আগেই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়েছে। তার গল্প-উপন্যাস ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠি, কানাড়ি, রুশ, মালে, মালয়ালাম, ফরাসি, জাপানি, কোরিয়ান, উর্দু, ফিনিস (ফিনল্যান্ড), আরবিসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েটি ভাষায় অনূদিত হয়।
ঔপন্যাসিক হিসেবে সেলিনা হোসেন বহুবিধ দ্বন্দ্বকে নানাভাবে অনুসন্ধান চালান। দ্বন্দ্বের পূর্ণ চরিত্রটিকে উপস্থাপন করেন আমাদের সামনে। এই অনুপুক্সক্ষতার কারণে ঘটনার সঙ্গে লেখিকার দূরত্ব ঘুচে একাকার হয়ে যায়। যা তার কাহিনিকে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পাঠককে অনুপ্রাণিত করে। কাহিনি মগ্নতার ভেতরে ডুবে থাকা পাঠক অজ্ঞতাবশত বুঝতেও পারেন না। তার অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে—মগ্ন চৈতন্যে শিস (১৯৭৯, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮১ লাভ), পোকা মাকড়ের ঘরবসতি (১৯৮৬, কমর মুশতারী পুরস্কার ১৯৮৭ লাভ), কাঁটাতারে প্রজাপতি (১৯৮৯), যুদ্ধ (১৯৯৮), কাঠ কয়লার ছবি (২০০১), মোহিনীর বিয়ে (২০০২), আণবিক আঁধার (২০০৩), ঘুমকাতুরে ঈশ্বর (২০০৪), মর্গের নীল পাখি (২০০৫), গেরিলা ও বীরাঙ্গনা (২০১৪), দিনকালের কাঠখড় (২০১৫)। তার একটি কবিতার বইও রয়েছে, নাম ‘বর্ণমালার গল্প’।
আশির দশকের প্রথম থেকেই সেলিনা হোসেন বহির্বিশ্বে আমাদের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া অনেক সাহিত্য-সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও উদ্বোধকের আসনও অলংকৃত করেছেন। সাহিত্যে তার অনন্য কীর্তির জন্য দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে আছে—বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০), ফিলিপস্ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), একুশে পদক (২০০৯)। ভারত থেকেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—রবীন্দ্র্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা থেকে ডিলিট উপাধি (১৯১০), রামকৃষ্ণ জয়দয়াল ওয়ার্ড, দিল্লি (২০০৮), রবীন্দ্র্র স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা (২০১৩), আইআইপিএম (IIPM) কর্তৃক আন্তর্জাতিক সুরমা চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, দিল্লি (২০১২)। দক্ষিণ এশিয়ার লেখকদের জন্য প্রবর্তিত সাহিত্য আকাদেমি, দিল্লি থেকে ২০১১ সালে তিনি প্রেমচাঁদ ফেলোশিপ লাভ করেন।
কাহিনির অভিনবত্ব, জীবন নিষ্ঠা, দৃশ্যকল্প, বিস্তৃত বয়ান সেলিনা হোসেনের গল্প-উপন্যাসের সার্থক চলচ্চিত্র রূপায়ণে বাধিত করেছে। তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস-গল্প পরে চলচ্চিত্র ও নাটকে রূপান্তরিত হয়েছে। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
অনেক ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের অভিভাবকের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। নবীন সাহিত্যিকদের সাহিত্যের সঙ্গেও রয়েছে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। তাদের সাহিত্য পাঠ ও সাক্ষাতে তা বহুল বিস্তৃত। এদের সাহিত্য সৃষ্টি ও স্বীকৃতির ব্যাপারে নিজেকে রাখেন নৈর্ব্যক্তিকের ভূমিকায়। সরল জীবনযাপনের মতোই, নতুনদের সাহিত্যপাঠ ও স্বীকৃতি দানেও তিনি অকুণ্ঠ। যেমন প্রায় বিশ বছর আগে শহীদুল জহিরের ‘রাজনৈতিক জীবন ও বাস্তবতা’ উপন্যাসটি প্রথম পড়ার পর একটা বিশাল রিভিউও করেছিলেন। অথচ তখন অবধি শহীদুল জহিরকে চোখেও দেখেননি। তার অপরাপর কাজ সম্পর্কেও জানতেন না।
প্রতিনিয়ত সাহিত্যের ক্রম উন্নতিকেই তিনি স্বাগত জানান উদাত্তভাবে। তার বক্তব্য হলো, ‘পঞ্চাশের দশকে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ যা লিখেছেন, একবিংশ শতাব্দীতে এসে একজন নবীন লেখক তা লিখবেন আবার সেটা প্রত্যাশা করব না। তিনি হয়তো এ সময়কে ধরবেন, এ সময়ে গল্প নাও থাকতে পারে। কিন্তু এমন কিছু অত্যাশ্চর্য জিনিস থাকবে, যা সময়কে বিম্বিত করে, মানুষের জীবনকে নতুনভাবে বিম্বিত করে, আধুনিক বিশ্বকে বিম্বিত করে।’ প্রসঙ্গত বলা যায়, একটা সময় পর্যন্ত তিনি সাহিত্যে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। কিন্তু পরে প্রতিনিয়ত লেখনীর মাধ্যমে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ঠিকই, কিন্তু সাহিত্যের যথাযথ যত্ন নিতে পারেননি। অর্থাৎ একটি পোষমানা ভাষা ও সাহিত্যধারা অনুসরণ করেছেন। তবে তার সাহিত্য কখনোই ‘জনপ্রিয় ধারা’র মতো সংকীর্ণতায় আকীর্ণ হয়েছে বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই।
সাহিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে এতসব অর্জনের পরও সময়কেই তিনি সাহিত্যের বড় সমালোচক মনে করেন। ‘মানসম্মত রচনার মূল্যায়ন করবেন সমালোচক। সবার ওপরে বড় সমালোচক সময়। কালের বিচার বড় নির্মম। কাউকে ক্ষমা করে না, যা বাতিল হওয়ার যোগ্য তা স্বাভাবিক নিয়মে বাতিল হবে। বাংলাদেশের সাহিত্যমানের দিক থেকে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তুলনীয়।’
সেলিনা হোসেনের সাহিত্যের অনন্য দিক হলো—ইতিহাসের প্রভাব ও সেসব মানুষদের অংশগ্রহণ, যারা ওই ইতিহাসকে ধারণ করেছেন। যে কারণে তার সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অনেক। বলতে গেলে, বাংলাদেশ ও বাঙালির উৎস সন্ধানে তিনি নানাভাবেই ব্যাপৃত। তা ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অর্থাৎ তার সাহিত্যের চরিত্ররা নানাভাবে পীড়িত হলেও উন্মুল হয় না। তাদের জীবনে ইতিহাস, সমাজ, সময়, সংগ্রাম সমানভাবে সক্রিয় থাকে। উৎস থেকে উৎসারিত, সতত বহমান এসব জীবন যেন নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনির মতোই তাদের সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করে যাচ্ছেন। একইভাবে উৎস থেকে উৎসারিত নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনির মতো লেখিকা এখনো এক-একটি সাহিত্য সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। আশা করা যায়, এই ধ্বনি আরো অনেক দিন বিচিত্র দ্যোতনায় অনুরণিত হবে।