সাক্ষাৎকার

পাঠক ছাড়া সাহিত্য অচল

পাঠক বড় না লেখক বড়? রেজাউদ্দিন স্টালিন মনে করেন, পাঠক বড়। কারণ লেখকের যেখানে শেষ, পাঠকের সেখানে শুরু

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : গোলাম কিবরিয়া

রেজাউদ্দিন স্টালিন বাংলা ভাষার শক্তিমান কবি। সমাজের নানা বিষয় নিয়ে তার মৌলিক চিন্তা আমাদের আলো দেয়। পেয়েছেন বাংলা একাডেমিসহ বহু দেশি-বিদেশি পুরস্কার। তারুণ্যের এই কবি মুখোমুখি পৌষের সঙ্গে

———————————————-

কবিতা কি ভাষার মুক্তি দিতে পারে?

রেজাউদ্দিন স্টালিন : ভাষার মুক্তি একটা বড় পরিপ্রেক্ষিত। এর সঙ্গে জড়িত থাকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন করেছি রক্ত দিয়ে। কিন্তু যে অর্থে ভাষার মুক্তি, তা অর্জিত হয়নি। একটা নয়া উপনিবেশ তৈরি করেছে সাম্রাজ্যবাদীরা। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নানাভাবে অবদমিত। সুতরাং ভাষা যেহেতু সমাজ ও রাষ্ট্রের মতপ্রকাশের বাহন, তার মুক্তিও বাধাগ্রস্ত। তবে কবিতা এক স্বাধীন মনোরাজ্যের বাসিন্দা। সে অধীমতার বিরুদ্ধে কখনো সরাসরি, কখনো রূপকে কথা বলে এবং কবি যখন তার সত্য প্রকাশের জন্য নতুন রূপক তৈরি করে, তখনই ভাষা সমৃদ্ধ হয়। ভাষার মুক্তি ঘটে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ প্রমুখের নাম স্মর্তব্য।

ভাষাশিক্ষার সঙ্গে পাঠ্যক্রমের সম্পর্ক কতটা?

স্টালিন : ভাষাশিক্ষা ঘটে মা ও পরিবার থেকে। আর প্রতিষ্ঠান পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে মানভাষা ব্যবহারের প্রকৌশল শেখায়। ভাষার পরিশীলন ও লেখ্যরূপ শেখায়। ছাত্রছাত্রীরা ভাষার শক্তিকে খুঁজে পায়। নতুন শব্দ প্রকরণ ও প্রত্যয় সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। তারা মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষার বহুরূপিতা আবিষ্কার করতে পারে। লেখ্য ও মৌখিক পরীক্ষায় গৃহীত শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারে।

সাহিত্য মানুষকে মানবিক করে। বাংলাদেশে সাহিত্যের চর্চাও কম নয়। তাহলে সমাজে এত নিষ্ঠুরতা কেন?

স্টালিন : এ কথা সত্য যে, সাহিত্যচর্চা কম নয়। কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে কেন। এজন্য কমছে, আমরা বই পাঠে প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের শিক্ষা এখন চাকরি আর অর্থ উপার্জনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। করপোরেট শিক্ষায় মানবিকতার মূল্য নেই। শুধু অর্থ দিয়ে মানুষকে মূল্যায়ন করা হয়। ফলে ইংরেজি মিডিয়ামসহ ধনাঢ্য ব্যক্তির সন্তানরা সাহিত্যের তোয়াক্কা না করে অপসংস্কৃতিতে বিনোদন খোঁজে। মধ্যবিত্তদের মধ্যে লেখাপড়ার কিছু অভ্যাস এখনো দূরীভূত হয়নি। একটা জ্ঞানকেন্দ্রিক সমাজ তৈরি ছাড়া এই বিমানবিক অবস্থার অবসান অসম্ভব। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার। ইউরোপ-আমেরিকায় মানবিক মূল্যবোধ উন্নয়নের জন্য স্কুলগুলোতে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়।

কবিতা সমাজ পরিবর্তনে কতটা ভূমিকা রাখে?

স্টালিন : কবিতার অন্তঃস্রোত মানবানুভূতির ওপর প্রবাহিত হয়। কবিতার ইতিহাস চার হাজার বছরের। কবিতা সত্য ও সুন্দরের উপাসক। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কবিতা সদা সোচ্চার। পরাধীন ভারতবর্ষে কবিতা নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা একেকজন মানুষকে, প্রকৃত প্রস্তাবে বাঙালি জাতিকে বীরের জাতিতে পরিণত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনÑ প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে কবিতা ঐতিহাসিকভাবে সম্পৃক্ত।

একুশের বইমেলা আমাদের সাহিত্যের উৎকর্ষে কতটা ভূমিকা রাখে?

স্টালিন : একুশ আমাদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাস। একুশের তাৎপর্য তৈরিতে বইমেলা প্রায় ৬০ বছর ধরে সক্রিয়। তবে অসম্পাদিত বই, ভুল বানান ও বাক্যে ছাপা বই একুশের তাৎপর্য বিনষ্ট করে। তবু অসংখ্য তরুণ লেখকের বই প্রকাশ পায়। লেখক-পাঠক মুখোমুখি হয়। বইয়ের সৌরভে আমৌদিত হয় আমাদের অন্তরলোক। এজন্য বইমেলার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

ছাপার হরফে বই আর ই-বুক। দুটোই প্রকাশের মাধ্যম, কোনটি শক্তিশালী?

স্টালিন : প্রযুক্তি সভ্যতার পরাগায়ণ ঘটায়। নতুন গতি এনে দেয়। সেজন্য সাহিত্যের বৈশ্বিকতা বাড়ে। তবে ছাপা বই হচ্ছে ধ্রুপদি পাঠধারা। স্পর্শযোগ্য এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে বই বসে-শুয়ে পড়া যায়, এমনকি অন্ধকারেও বিদ্যুৎ ছাড়া সামান্য আলোয় বই পড়া যায়। সড়কপথ, নদীপথ, বিমানপথ, রেলপথ যখন পাশাপাশি আছে, সে রকম ই-বুক ও ছাপা বই পাশাপাশি থাকবে। কারণ দুটি মাধ্যমই শক্তিশালী।

অনুবাদ শিক্ষা ও সাহিত্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার লেখা ৪২টি ভাষায় অনূদিত। তাতে বাংলা ভাষা কতটা লাভবান হবে?

স্টালিন : অনুবাদ শিক্ষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন ধারণা দেয়। অভিজ্ঞতা বাড়ায়। বিশ্ব বীক্ষা ও সাহিত্যের নতুন স্রোত সৃষ্টি করে। পৃথিবীর অন্যান্য কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এজন্য আমাদের সেরা সাহিত্য অনুবাদ ও প্রকাশ করতে হবে এবং বাইরের দেশগুলোতে পাঠাতে হবে।

পাঠক বড় না লেখক বড়?

স্টালিন : পাঠক বড়। কারণ লেখকের যেখানে শেষ, পাঠকের সেখানে শুরু। লেখক যেটুকু লিখতে পারে না, তা পাঠক লিখে ফেলে। পাঠক ছাড়া সাহিত্য অচল। চাঁদে অঢেল সোনা কিন্তু ব্যবহারের লোক নেই। সোনা যেমন মূল্যহীন, তেমন অনেক বই, পাঠক নেই—বইও মূল্যহীন।

Leave a Comment

বিজ্ঞাপন

সম্পাদক : মীর হেলাল । শিল্প নির্দেশক : বদরুল হায়দার । © 2023 পৌষ
editor@poushh.com । তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা । 01914 441 825