সাক্ষাৎকার

আমরা বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত

—নূর কামরুন নাহার

নূর কামরুন নাহার। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস নির্মাণে বোদ্ধামহলে প্রশংসিত হয়েছেন। জন্ম ১৯৭১ সালে। বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে ডিজিএম হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত বই ১৭টি। এই কথাসাহিত্যিক ও কবির মুখোমুখি অচিন্ত্য চয়ন


 

আপনার বেড়ে ওঠার গল্প বলুন।

বেড়ে উঠেছি এই ঢাকায়। বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটির সঙ্গে হৃদ্ধতা ঘটেছে তা হচ্ছে বই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বাসায় বই দেখেছি। বাবা জনসংযোগে কাজ করেছেন। তাই বাসায় আসতো দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন সাময়িকী। আব্বা-আম্মা দুজনেই লিখতেন। আম্মার কণ্ঠ ছিল অসাধারণ। তাই বেড়ে ওঠাটা ছিল বইয়ের সঙ্গে। আরো যদি বলি গানের সঙ্গে।

লেখালেখিতে কীভাবে এলেন?

আগেই বলেছি, শৈশব থেকে পরিবারে লেখালেখির পরিবেশ ছিল। সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ ছিল। সে থেকেই লেখালেখিতে আসা। তবে লিখবই এমনটা ভাবিনি। আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে ডিটেকটিভে। সেখানে পরপর কয়েকটি গল্প ছাপা হয়। তখনো সিরিয়াসভাবে লেখালেখিতে আসিনি। তারপর অনেকদিন লেখালেখি বন্ধ ছিল। ১৯৯৯ সালে লেখালেখি শুরু করি। তখন যায়যায়দিনে গল্প, ভোরের কাগজ এবং যুগান্তরে জেন্ডার ইস্যু নিয়ে প্রবন্ধ-ফিচার প্রকাশিত হয়। প্রথম বই বের হয় ২০০৫ সালে। তারপর ২০০৯ সালের মধ্যে তিনটি বই বের হয়। লেখালেখিটা অনেক দিন থেকে থাকলেও লিখবই এ রকম একটি তাড়না ২০০৯ থেকে অনুভব করি।

একজন শিল্পীর কি সামাজিক দায় থাকা জরুরি?

আমি মনে করি অবশ্যই শিল্পীর সামাজিক দায় রয়েছে। শিল্পী তো সমাজ বিচ্ছিন্ন কোনো মানুষ নয়, তবে কেন তার সামাজিক দায় থাকবে না। আবার দায় মানে এই নয় লেখককে কোথাও দাসখত দিতে হবে। লেখকের লেখার, মত প্রকাশের অবশ্যই স্বাধীনতা রয়েছে। সৃজনশীলতা কোনো দেয়ালকে স্বীকার করে না। কিন্তু এই স্বাধীনতার মধ্যেই একজন লেখককে নির্ধারণ করে নিতে হবে তার সামাজিক দায়বোধের।

জীবন ও কল্পনা মিলিয়েই শিল্পের সৃষ্টি হয়। আপনার সৃষ্টির জন্য কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং কেন?

শিল্পের জন্য অবশ্যই জীবন প্রয়োজন, সেইসঙ্গে প্রয়োজন প্রখর কল্পনাশক্তির। একজন লেখককে জীবন দেখা এবং একইসঙ্গে কল্পনায় জীবনকে আঁকা দুটোতেই সমান দক্ষ হতে হয়। জীবনের গল্পগুলোয় কল্পনার মিশেলে শিল্প সৃষ্টিতে আমি উৎসাহী। তবে জীবনের দিকেই আমার পক্ষপাত রাখি।

অনেক পাঠকের কাছে এবং কিছু কিছু লেখকের মুখেও শোনা যায়—বর্তমান কবিতার শরীরে দুর্বোধ্যতা ঢুকেছে। এখানে আপনি কার ব্যর্থতা ধরবেন, পাঠকের না লেখকের?

আমি একটু আগেই বলেছি, আমাদের এই সময়টাতে আমরা এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত। এই বিচ্ছিন্নতা বোধ আমার মনে হয় কবিতার শরীরেও প্রবেশ করেছে। এ সময়ের বহু কবিতায় চমৎকার শব্দ এবং চিত্রকল্প দেখা যায় কিন্তু এটার যেন কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। যেন গন্তব্যহীন এক যাত্রা।

আমি সব সময়ই জীবনমুখী মানুষ। আমি চাই জীবনের গভীর নিবিড় উপস্থাপন, আর সেখানেই প্রকাশিত জীবনের শিল্পিত রূপটি। জীবনবর্জিত শিল্প তাৎক্ষণিক কিছু চমক সৃষ্টি করতে পারলেও তা কালের প্রবাহে টিকে থাকার সম্ভাবনা কম

সাহিত্যের সব সৃষ্টি জীবনকেন্দ্রিক। জীবনবর্জিত শিল্পকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন? শিল্পের জন্য শিল্প নাকি জীবনের জন্য শিল্প।

এ বির্তক পুরোনো। আমি সব সময়ই জীবনমুখী মানুষ। আমি চাই জীবনের গভীর নিবিড় উপস্থাপন, আর সেখানেই প্রকাশিত জীবনের শিল্পিত রূপটি। জীবনবর্জিত শিল্প তাৎক্ষণিক কিছু চমক সৃষ্টি করতে পারলেও তা কালের প্রবাহে টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। মানুষ সবসময়ই জীবন খুঁজে বেড়ায়। নিজেকে দেখতে চায় শিল্পের ভেতর।

বাংলা কবিতা নিয়ে আপনার অভিমত কী? যে ধারার কবিতা লেখা হচ্ছে সেই ধারা আপনার কেমন লাগে এবং কবিতার ভবিষ্যৎ কী?

বাংলা কবিতা নিঃসন্দেহে এগিয়েছে। কবিতায় অনেক চমৎকার চিত্রকল্প দেখা যায়। জীবনবোধের ও জীবনযাপনের যন্ত্রণা কবিতা ধারণ করতে পেরেছে। তবে যেটি আগেও একবার বলা হয়েছে—কবিতার মধ্যে দুর্বোধ্যতা এবং কবিতা অনেক সময় চমৎকার কিছু শব্দের আকর হলেও অর্থহীন হয়ে ওঠছে। এদেশের মানুষের মধ্যে স্বভাবজাতভাবে কবি বসবাস করে। কবিতার ভবিষৎ অবশ্যই ভালো।

সাহিত্য হলো জীবনবোধের বহিঃপ্রকাশ। এই বহিঃপ্রকাশের হাত ধরে জাতি পার করেছে ৫২ বছর। আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

বাংলাসাহিত্য এবং বাংলাদেশের সাহিত্য অবশ্যই অগ্রগতি অর্জন করেছে। সাহিত্যে জীবনবোধের প্রকাশের যে বিষয়টি রয়েছে সেটিও আমাদের সাহিত্য নানাভাবেই ধারণ করেছে। তবে বিষয় হচ্ছে, পুঁজিবাণিজ্য সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে নানারকম সাহিত্য রচিত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলো হয়তো জীবনকে ততটা প্রকাশ করতে পারেনি, এইসব বই আমাদের তরুণদের কাছে প্রচুর জনপ্রিয় হয়েছে। লেখকরা মোহে পড়ে লিখেছেন, প্রকাশকরা বাণিজ্যের জন্য ওইসব বইকে প্রাধান্য দিয়ে ছেপেছেন; এইভাবে হালকা বিনোদনের জন্য লেখা বইয়ের একটা ধারাও চলে এসেছে। এটা সবসময়ই থাকে। কিন্তু জীবনের গভীর বোধ আমাদের সমাজসংস্কৃতি ঐতিহ্য জীবনধারা, লোকজ নানাউপাদানও আমাদের সাহিত্যে উঠে এসছে।

বাংলাদেশে এখন অনেক লিটলম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশতে ছোটকাগজের আদর্শ ও মৌলিকত্ব বজায় থাকছে না। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

লিটলম্যাগ অনেক প্রকাশিত হচ্ছে। বিষয়টা আমার কাছে ইতিবাচক। ছোটকাগজের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অবশ্যই আছে। একটা আদর্শ এবং ছোটকাগজের একটা লক্ষ্যও রয়েছে। তা থেকে অনেকগুলোর মধ্যেই আমরা বিচ্যুতি হয়তো লক্ষ্য করি। বিশেষ করে আমাদের এইসব কাগজে গ্রুপিং দেখা যায়, যার ফলে প্রকৃত লেখক তৈরির জায়গাটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারপরও ছোটকাগজের প্রকাশকে আমি স্বাগত জানাই। অনেক ছোটকাগজের লেখার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, আমার মনে হয়, তরুণ লেখকরা লেখার প্ল্যাটফরম পাচ্ছে। এসব লেখক থেকেই একদিন বেরিয়ে আসবে প্রকৃত লেখক।

আপনি দশককে কতটুকু মূল্যায়ন করেন বা বিশ্বাস করেন?

দশক মূল্যায়ন নিয়ে নানা বির্তক আছে। মূলত দশক দিয়ে তো আর সাহিত্য বিচার করা যায় না। তবে সময়ের প্রবাহকে বুঝতে এবং বিশেষ সময়ের একটা বিশেষ ধারা বুঝতে দশক বিভাজনে এক ধরনের মূল্যায়ন করা হয়। সময় সাহিত্যের জন্য একটা বড় বিষয় কাল বা সময় বোঝার জন্য দশক চিন্তা করা যেতে পারে, তবে দশকের মধ্যেই সব সীমাবদ্ধ নয়।

Leave a Comment

বিজ্ঞাপন

সম্পাদক : মীর হেলাল । শিল্প নির্দেশক : বদরুল হায়দার । © 2023 পৌষ
editor@poushh.com । তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা । 01914 441 825