আপনার কবিতার বইয়ের নাম ‘এই আমি কোথাও নেই’—আপনি কী সত্যিই কোথাও নেই? কী অভিপ্রায় আপনার এ রকম নামকরণে, নাকি কেবলই চমক?
না, চমক নয় মোটেই। চমকে আমার বিশ্বাস নেই। আমি মূলত সময়কে ধরতে চেয়েছি। লালন যেমন বলেছেন- ‘ধরো মন হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে।’ একটু খেয়াল করলে দেখবেন, আমরা এমন একটা সময়ের ফাঁদে পড়েছি, যেখানে ব্যক্তির নিজস্বতা বলে কিছুই নেই। উত্তরাধুনিক সময়ের জটিলতা ও বাস্তবতাকে এভাবেই দাঁড় করানো হচ্ছে, সদর্থক অর্থে কোনো বুদ্ধিজীবী নেই বলে। এমনকি রাষ্ট্র-রাষ্ট্রের জায়গায় নেই, গণমাধ্যম-গণমাধ্যমের জায়গায় নেই, বিশ্ববিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় নেই। তা হলে মানেটা দাঁড়াল কি—আমরা কেউ কোথাও নেই। করোনা মহামারির অভিজ্ঞতায় সেটা আরো অনেক বেশি স্পষ্ট হয়েছে। ‘এই আমি কোথাও নেই’ মূলত সবাইকে নিজেদের জায়গায় ফেরার আহ্বান।
আপনার একটা কবিতার পঙ্ক্তি এ রকম—‘মানুষটা সবাই হয়, মানুষ কেউ কেউ কেবল’। এভাবে বললেন কেন, মানুষের জন্য ভাবনায় কি কেউ নেই?
মানুষ অরণ্য ছেড়ে লোকালয়ে আসার পর, সবচেয়ে মন্দ সময়টা বুঝি পার করছে এখন। এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে এসেও যদি মানুষের এই হাল হয়, তাহলে এসব প্রযুক্তি, উন্নয়ন কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় না? আমার ভেতরের এই প্রশ্ন, এই সিদ্ধান্ত হাজির করে যে, মানুষ আসলে এখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। এ কারণেই আমার অনুসন্ধান, ‘মানুষটা সবাই হয়, মানুষ কেউ কেউ কেবল।’
আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা কতটা হচ্ছে? বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একটা দেশের জন্য কেন জরুরি?
বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একটা দেশের জন্য কেবল জরুরি নয়, অপরিহার্য। একটা দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ওপর। যেকোনো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির শক্তিই হলো তার বুদ্ধিজীবিতার শক্তি। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের যে বিজয়, সেটা মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিজয়। একজন কৃষক যে যুদ্ধে গিয়েছিল, একজন মুটে, মজুর কিংবা কুলি। এভাবে লাখে লাখে মানুষ যে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সেটা কেন ও কীভাবে সম্ভব হলো, এই প্রশ্নের উত্তর একটাই- বুদ্ধিজীবীরা সেই আবহ নির্মাণ করেছিল। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এখন সংঘজীবী হয়ে গেছেন, দলজীবী-দলদাস হয়ে তারা নিজেদের আখের গোছানোতে ব্যস্ত রয়েছেন, দেশ রাষ্ট্র সমাজ ও মানুষ তাদের কাছে গৌণ হয়ে গেছে।
৪০ বছর বয়সের আগে বইপ্রকাশ কোনোভাবেই নয়, বিশেষ করে মননশীল বই। খুব ভালো হয় কেউ যদি ৫০ বছরের প্রস্তুতি নিয়ে লেখালেখিতে আসেন
আপনি নিয়মিত পত্রপত্রিকায় লিখছেন। কিন্তু বই প্রকাশে অনীহা, এ ব্যাপারে নিজস্ব কোনো ভাবনা বা দর্শন আছে কি?
নিয়মিত লিখছি কি? বই প্রকাশে অনীহা নয়, প্রস্তুতি নিয়ে বই করতে চেয়েছি- সৃজনশীল মননশীল উভয়ক্ষেত্রেই এই ভাবনা কাজ করেছে। আমরা তো শিখেছি, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক, মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি এভাবেই শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতা পাড়ি দিতে হয়। ঠিক লেখালেখিতেও একটা ধারাবাহিকতা থাকা জরুরি। আমাদের এখানে মননশীল বইয়ের সংখ্যা কম, তার পাঠক আরো কম। অথচ সমাজ রাষ্ট্র দেশ নির্মিত হয় তার মননশীলতার ওপর। ৪০ বছর বয়সের আগে বইপ্রকাশ কোনোভাবেই নয়, বিশেষ করে মননশীল বই। খুব ভালো হয় কেউ যদি ৫০ বছরের প্রস্তুতি নিয়ে লেখালেখিতে আসেন। তার আগে বড়জোর ড্রেস রিহার্সেল হতে পারে, যা মহড়ার জন্য মানায় কিন্তু দর্শকের সামনে মঞ্চায়নের জন্য কোনোভাবেই নয়।
সাহিত্যের জন্য আড্ডা, মেলা ও পাঠচক্র কতটা সহায়ক বলে মনে করেন?
অনেক বেশি সহায়ক, আবার ক্ষতিকরও। লেখালেখি বা সাহিত্য চর্চার জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু সম্ভবত নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, আড্ডাটা আদতে সাহিত্যের জন্য হচ্ছে কিনা। আমাদের এখানে সাহিত্যের আড্ডার মধ্যেও এক ধরনের গোষ্ঠীপ্রিয়তা ঢুকে গেছে। সংঘবদ্ধতার নামে একে অপরের পিঠ চাপড়ানিটা মুখ্য হয়ে উঠেছে। আসলে লেখালেখির জন্য নিঃসঙ্গতার কোনো বিকল্প নেই। আড্ডা মেলা পাঠচক্র এসবের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ভালো, এগুলোর প্রয়োজনীয়তা চিরকালীন কিন্তু এর সঙ্গে বিযুক্ত হওয়ার সাধনাটাও জরুরি।
দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি অনেক হয়েছে বলে কারো কারো অভিমত। কিন্তু উল্লেখ করার মতো কাজ তেমনভাবে মেলে না? এসব জায়গায় গবেষণার সংকট মূলত কোথায়?
দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির, এই ভূগোলের মানুষের এমন একটা প্রপঞ্চ, যা নিয়ে আরো বেশি লেখালেখি হওয়া দরকার। এর সঙ্গে আমাদের আবেগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গগুলো এমনভাবে জড়িত, যা ছাড়া আমরা সবক্ষেত্রেই ঊনমানুষ বলে বিবেচিত হওয়ার সংশয় রয়েছে। আলটপকা যারা বলেন ঢের হয়েছে, তারা কোনো প্রকার অনুসন্ধান ছাড়া বলেন কিংবা যথার্থ বলেন না।
আমাদের এখানে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে তেমনভাবে গবেষণার চর্চা নেই। যা কিছু হচ্ছে ওখানেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার গবেষণার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় ও ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ। ফলে এখানে গবেষণার পরিবেশ এখনো উন্মুক্ত হয়নি। এই বাস্তবতায় দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আশাপ্রদ কাজ অপ্রতুল। রাষ্ট্রের এ ব্যাপারে কোনো হেলদোল যেমন নেই, তেমনি বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোরও এদিকে কোনো প্রকার আগ্রহ নেই। এমনকি দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও আমরা এখনো গবেষণামনস্ক জাতির অবয়ব দাঁড় করাতে পারেনি।
‘এই আমি কোথাও নেই’ নিয়ে কিছু বলেন। এই বইয়ের বার্তাটা কী?
কোনো বার্তা দেওয়া কবির কাজ না। কবির কাজ কবিতা লেখা। বার্তা খুঁজবে পাঠক ও গবেষক। এই বইয়ে আমি কিছু প্রশ্ন হাজির করেছি। এসব প্রশ্ন সামনে আসা প্রয়োজন। ‘এই আমি কোথাও নেই’ মূলত কবিতার মোড়কে চিন্তার বই। নিজেদের ভাবনাকে আলোড়িত করার বই। জীবন জগৎ ও তার পরিপার্শ্বকে গভীরভাবে বোঝা ও অনুসন্ধান করার বই। যা প্রকাশ করতে গিয়ে আমি মাধ্যম হিসেবে কবিতার আশ্রয় নিয়েছি। এই বই কবিতার শক্তিকে কতটা ধারণ করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন হতে পারে, তর্ক হতে পারে। কিন্তু এই বই চিন্তার শক্তিকে হাজির যে করেছে, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ কম। আমি মনে করি, চিন্তা শক্তির বিবিধ মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে এই বইয়ের প্রতিটি কবিতায়, ফ্ল্যাপে, উৎসর্গপত্রে এমনকি নামকরণেও।