গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা যাদের, তাদের চান্নি রাইত বা পূর্ণিমার রাইত অথবা জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্যের কথা বলে দিতে হয় না। পূর্ণিমা বা চান্নি, চাঁদের একটি কলা। এটি তখনই হয় যখন চাঁদ পৃথিবীর যে পাশে সূর্য, তার ঠিক উল্টো পাশে যখন অবস্থান করে। চন্দ্রের আলোতে আলোকিত রাতকে গ্রামে আঞ্চলিক ভাষায় ‘চান্নি রাইত’ বলে। আলো নাকি আঁধার— কোন রহস্যের মায়া এই চান্নি রাইত? জানা হয় না এই ঘোর রহস্যের কিনারা। ছোটবেলায় সন্ধ্যা হতেই পুবের ঘরের জানালা খোলে চেয়ে দেখতাম আকাশে থালার মতো বড় ঢলঢলে চাঁদ। চৈত্র মাসে গরমে ঘুম আসত না, ঘরের উঠানে চাটাই বিছিয়ে ছোট আপুসহ আম্মাকে মাঝখানে আর আমরা দুই ভাই-বোন দুপাশে শোয়ে গল্প শোনতাম। আম্মা বলে যেতেন নমরুদ, ফেরাউন, নীলনদ, মুসা (আ.)-এর লাঠি থেকে সাপ হয়ে যাওয়ার কাহিনি। নবীজি (সা.)-এর ছোটবেলা, ব্যাঙকুমারের বিয়ে, জোলা বামন, আলীবাবা চল্লিশ চোর, কাঠুরিয়া, রাজকন্যা আর বানরের গল্প। চান্নি রাইতে দাদুর কাছেও গল্প শোনতাম আমরা। দাদু বলতেন পরীদের গল্প। চান্নি রাইতে পরীরা পরীস্থান থেকে রথে চড়ে পৃথিবীতে চলে আসে। ওরা এসে বাগানে ফুলকলিদের ঘুম ভাঙায়, এতে ফুল ফোটে। ফুলবাগান বা খোলা জায়গায় চাঁদের আলোতে সারারাত ধরে চলে পরীদের নাচণ্ডগান। দাদু বলতেন, ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত ওরা থাকতে পারে পৃথিবীতে। ফর্সা হতেই আবার রথে চড়ে চলে যায় পরীস্থান। আমাদের বাড়িতে ফুলের বড় বাগান ছিল, তাই চান্নি রাইত এলেই আশা নিয়ে থাকতাম, কবে দেখা হয়ে যায় পরীদের সঙ্গে। আমাদের শান-বাঁধানো পুকুরঘাটে দাঁড়ালে মনে হতো কাঁপছে জল তির তির করে। আর ওপর থেকে খেলা করছে মায়াবী চাঁদের আলো।
ছেলেবেলায় গ্রামে থাকতে দেখতাম চান্নি রাইতে কিচ্ছা হতো। দলবেঁধে কয়েকজন লোকের মধ্যে একজন কিচ্ছা বা গল্প বলে যেতেন, অন্যরা পেছন থেকে ধরতেন জোরে একসঙ্গে। বানেছা পরীর কিচ্ছা, রূপবান রহিম বাদশাহ, বিজয়িনী সোনাভান, কালারাম ডাকাতের কিচ্ছা অইতো। জারি গানের প্রতিযোগিতা হতো পশ্চিমপাড়া আর দক্ষিণপাড়ার মধ্যে। পুরস্কার হিসেবে সিল দেওয়া হতো। পরদিন ওই সিল নিয়ে মিছিল করত পাড়াময়। সবাই যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা, চাল, ডাল ও আলু দিত। পরে সবকিছু একসঙ্গে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হতো। গ্রামে এটা ছিল অন্যরকম এক অনুভূতি ও আনন্দ।
চান্নি রাইতে তখন গাডো গানের আসর বসত গ্রামে। অল্পবয়সি সুন্দর একটা ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে নাচ-গান হতো। সবাই গাডো নামে ডাকত ছেলেটাকে। গ্রামের লোকজন গাডো ছেলেটাকে নিয়ে সমালোচনা করত। আমাদের উঠানের পাশেই ঘরের পেছনে ছিল বড় জঙ্গল। পূর্ণিমার আলোতে ছায়া পর্যন্ত দেখা যেত। কলাগাছের লম্বা পাতা বাতাসে যখন দোল খেয়ে কাঁপত, তখন মনে হতো, দূর থেকে হাতছানিতে কেউ যেন ডাকছে। ভয়ে অন্য কোথাও না তাকিয়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে শোয়ে থাকতাম। উঠানের পরই বাড়ির সামনে পূর্বদিকে আমাদের বড় পুকুর। পুকুর পাড়ে ছিল পুরোনো একটা শিমুল, কয়েকটা তালগাছ। তালগাছের চিকন চিরল পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো চোখে এসে লাগত। একটু দূরেই পাট জাগ দেওয়ার দুটো পাগার বা জলাশয়। জলাশয়ের পাড় ধরে ছিল কাশবনের সারি। সাদা শাড়িতে সাজ তো কাশবন। মুরব্বিরা বলতেন কাশবনে বিষাক্ত দাঁড়াশ সাপ থাকে, ফলে খুব কমই যেতাম, তবে মাঝেমধ্যে কয়েকজন দলবেঁধে বাতাকালি খেতে যাওয়া হতো।
আমাদের বাড়িতে বছরি মুনি ছিল বজলু। জোয়ান, কালো, পিটানো শরীর। কাজ করতে পারত খুব। বজলু আমাকে চান্নি রাইতে মাছ ধরতে ধানখেতে নিয়ে যেত। পানির নিচে ধানগাছ। চাঁদের আলোতে আধো আলো আধো ছায়ায় মেঘের ভেতর বারবার লুকিয়ে যাওয়া চাঁদের রূপ অন্যরকম। কেননা, বৃষ্টি ও জ্যোৎস্না একসঙ্গে কমই দেখা যায়। বজলু বলত, ‘ভাইছা চৈত মাসো এমুন চান্নি উডে, অক্করে শইল্যের লোম্বা (লোম) দেহা যায়।
বাড়ির উঠানে ছোট আপুর ফুলবাগানে শিউলির ঘ্রাণ ছড়িয়ে জ্যোৎস্না রাত ছিল ভয়ের। সবাই বলত, ফুলের সুবাসে সাপ আসে। অনেকেই নাকি দেখেছে সাপকে। চান্নি রাইতে গ্রামে বাঁশি বাজানো ছিল অন্যরকম সখ বা অনুভূতি। আমাদের বাড়ি থেকে অল্প দূরে উঁচু মাটির ঢিবি বা ঠেক ছিল। কয়েকটা তেঁতুল, কড়ই আর জারুলগাছ ছিল সেখানে। ওপাড়ার ছেলে আবদুল হাই, চান্নি রাইত হলেই মন উজাড় করে বাঁশি বাজাত। দেখা গেল ঘুমাতে যাব, দূর থেকে বাঁশির সুর ভেসে এলো। মুরব্বিরা বলতেন,
– আবদুলি ছেড়াডার সাহস কত, এমুন জায়গাতো বইয়া বাঁশি বাজায়, রাইতে পরীরা আইয়া বাঁশির লগে নাচে, বাঁশি বাজা বন্ধ অইয়া গেলেই ঘাড়টা মোচড় দিয়া ভাঙ্গেয়ালবো।
আমি ভয় নিয়ে রাতে ঘুমাতে পারতাম না। পরদিন সকালে যদি শুনি আবদুল হাই ঘাড় মটকানো অবস্থায় ঠেকের ওপর মরে পড়ে আছে।
পশ্চিমপাড়ার সাহেবালি মাস্টারের বাড়ির কাছেই বাঁশি বাজাত আবদুল হাই। মাস্টার সাহেব প্রায়ই আব্বার কাছে বিচার নিয়ে আসতেন,
– চেয়ারম্যান সাইব, আবদুলি ছেড়াডার বিচার হরুইন।
– কেন কী হয়েছে মাস্টার? আব্বা জিজ্ঞেস করতেন।
– বুঝোইন্না, ঘরো আমার বিয়ার লাইক তিনডা মাইয়া আছে। বাঁশি বাজাইলে পোলাফানের মাথাডা খাইয়ালবো চেয়ারম্যান সাইব।
– দেখা যাক, ওর বাবাকে বলে দিবোনে। আব্বা আশ্বস্ত করতেন।
আমাদের বাড়িতে সব সময় লজিং মাস্টার থাকতেন। তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। শাহজাহান স্যার ছিলেন লজিং মাস্টার। তখন এলাকায় ওয়াজ মাহফিল হতো। চান্নি রাইত হালকা শীতের সময়। স্যারের সঙ্গে ওয়াজ শুনতে যেতাম। আসার সময় অনেক রাত হয়ে যেত, আমার হাঁটতে কষ্ট হতো, তখন স্যার আমাকে তার কাঁধে উঠিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। সারা রাস্তায় চান্নি রাইতের সৌন্দর্য বর্ণনা করতেন স্যার।
এক দিন এক চান্নি রাইতের কথা। আমাদের বাড়ির সামনে কাছারি ঘর। ঘরের বারান্দায় সারি করে চেয়ার-টেবিল পাতা। আব্বা আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, তাই লোকজনের বসার আয়োজন সব সময়। আমি সন্ধ্যার পর লম্বা একটা টুলে শোয়ে আমার কেনা ছোট রেডিওতে ‘দুর্বার’ অনুষ্ঠানে অনুরোধের আসরে সিনেমার গান শুনছি, আর চান্নি রাইতের দৃশ্য দেখছি। লজিং মাস্টার শাহজাহান স্যার বলছিলেন,
– বইসা চান্নিরাইতের দৃশ্য বোঝা যায় না, এতে আসমানের দিগে চাইয়া থাকলে ঘাড় বিষ (বেদনা) অইবো। চান্নি দেখবা শুইয়া। পুরাডা দেখতারবা।
রেডিওতে ছন্দ হারিয়ে গেল সিনেমার গান চলছে ‘স্মৃতিময়, এইদিন চিরদিন বুঝি আর হলো না’। ভয়ে বেশি দূরে তাকাই না। বাড়ির উত্তর দিকে আমাদের পারিবারিক কবরস্থান। পূর্বদিকে হিন্দুদের শশ্মান বা সিতাশাল। হঠাৎ দেখি চার থেকে পাঁচ হাত লম্বা চিকন মাটিতে কি যেন আসছে বুকে ভর দিয়ে। বড় সাপ মনে করে একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতর, চিৎকার শুরু করে দিলাম,
– আব্বা, আম্মা অতো বড় হাপ (সাপ), বাইর বাইত, আও তোমরা।
আব্বা শোনে বেরিয়ে এলেন তার লাইসেন্স করা বন্দুক নিয়ে, কারণ যে লম্বা সাপ বলেছি, তা লাঠি দিয়ে মারা কঠিন হবে। কয়দিন আগেও আমাদের জঙ্গলে গাছে পেঁচিয়ে থাকা বড় এক সাপ আব্বা গুলি করে মেরেছেন। বছরি মুনি বজলু হালের ফলা নিয়ে এলো। আমি কাছে না গিয়ে দূর থেকে দেখিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। বজলু ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে আব্বাকে বলল,
– চাহাজি এইডা হাপ (সাপ) না। কলাগাছের ডাগ্গোয়া।
সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিল। আব্বা রেগে আগুন হয়ে বললেন,
– এই ছেড়াডা (ছেলেটা) অতো বড় বলদ কেমনে অইলো। কলার ডাগ্গোয়ারে হাপ (সাপ) বানাইয়ালছে। নন্দলাল অইছে, খালি ভাত খাওয়াও, ডেগ ভইরেয়া।
শরমে আমি শেষ। দৌড়ে গিয়া দাদুর সঙ্গে শোয়ে রইলাম।
গ্রামে চান্নি রাইতে আত্মীয় বাড়িতে বেড়ানোর ধুম পড়ে যেত। মেয়ে আসত বাপের বাড়িতে জামাই নিয়ে। রান্না ঘরে ঢেঁকিতে পিঠার চাল কুঠার শব্দ, মধ্যরাত পর্যন্ত পিঠা বানানো, সম্পর্কে বিয়াই-বিয়াইন যারা, তারা খুনসুটি করতেন, হাসি-মশকরায় মেতে থাকতেন। কৃষাণীর থাকত শত ব্যস্ততা। চান্নি রাইতে প্রেমিক-প্রেমিকা দেখা করত বেড়ানোর উসিলায়, বড় কুয়া বা ইন্দিরা থেকে পানি আনতে গিয়ে। কাজের লোক, ছোট ভাই-বোনকে লজেন্স, পয়সা দিয়ে চিঠি পাঠাত একে অন্যকে। মাঝে মাঝে ধরাও পড়ত ভুল জায়গায় চিঠি পড়ে গিয়ে। তখন কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। দুপক্ষের বিচার, মাইর, সমালোচনায় মেয়েটির লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হতো। তবু একটা সুন্দর পরিবেশ ছিল গ্রামে। চান্নি রাইত গ্রামের সহজ সরল মানুষদের আরো কোমল মন করে দিত। মানুষ মন খোলে কথা বলত, প্রাণ খোলে হাসতে পারত।
আমরা সবাই ওই উজ্জ্বল চাঁদের মতো। যার সামনের দিক আলোকিত হলেও পেছনে থাকে কালো অধ্যায়। জীবিকার তাগিদে নিজ গ্রামের মায়া ছেড়ে শহরে তিতু হচ্ছি। তারপরও স্মৃতির জাবরকাটি গ্রামে কাটানো শৈশব থেকে যৌবনাবধি চান্নি রাইতের পদাবলি নিয়ে। তখন বিদ্যুৎবিহীন সেই অজপাড়াগাঁয়ে মায়া ছিল, টান ছিল, সম্পর্ক ছিল, সহমর্মিতা ছিল, যা আজ বিজলি বাতি এসেও মনকে আগের মতো আলোকিত করতে পারে না। দিতে পারে না চান্নি রাইতের মায়া, আবেগ ভয় ও ভালোলাগা।